Kangra c. 1830-40 |
মোরাম রাস্তার দুপাশে শাল আর ইউক্যালিপটাসের বনে শেষ বিকেলের
আলোর ছক বিনির্মিত হচ্ছে। এই বনটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। বহু বছর আগে অরণ্য কেটে ফেলার প্রায়শ্চিত্ত হয়তো। বাইকের পিছনে তাড়া করে আসছে একটা বীভৎস ধুলোর মেঘ। তার রঙ একটু বেশিই লাল। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল। আজকের দিনটা এমনিতেই সকাল থেকে ঝাপসা, মনমরা। ডিসেম্বর মাসেও নিম্নচাপ পিছু ছাড়ছে না। শীতটা ঠিকঠাক আসতে পারছে না।
‘সেই গানটাই গাইতে ইচ্ছে করছে, বুঝলি !’ অনিমিখ মজার সুরে
বলল, বাইক চালাতে চালাতে ঘাড় একটু ফিরিয়ে। পাকা রাস্তায় না ওঠা অবধি সে হেলমেট পরে না। মোরামের ধুলোয় অবিশ্যি
চুলের রঙ বদলে যায়। বাড়ি ফিরে স্নান করতেই হয় রোজ।
‘কোন গান?’ জিজ্ঞাসা করল মিলন। তার গলা একটু আবছা। সেটার কারন অবিশ্যি তার
মাথার হেলমেট নয়। সারাদিনের ক্লান্তি হতে পারে। হতে পারে সে এখন একটু মন খারাপ টের পাচ্ছে।
‘সেই যে, উত্তম-সুচিত্রার … এই পথ যদি না শেষ হয়! ‘হারানো সুর’ সিনেমার ওই গানটা আজ আমাদের এই সিচ্যুয়েশনে
খুব মানানসই মনে হচ্ছে, না? আর তো এইভাবে
এই রাস্তায় একসঙ্গে আমরা যাবো না।’
মিলন গলার মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। একটু কেশে বলল, ‘হ্যাঁ। এবার প্রতিদিন আমাকে আমার হাড় বের করা সাইকেলটা চালিয়েই এই রাস্তাটা
পেরোতে হবে। তুই সাড়ে দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা পান মুখে দিয়ে তোর নতুন
স্কুলে যেতে পারবি, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবি
পানটা ফুরোবার আগেই।’
‘হিংসে করছিস?’
ইঞ্জিনের গর্জন আর দুই চাকার তলায় মোরামের আওয়াজ ছাপিয়ে মিলনের
গলা শোনা গেল, ‘করছি হয়তো একটু। তবে ওই গানটা ‘হারানো সুর’-এর নয়। ওটা ‘পথে হল দেরি’-র। অগ্রদূতের পরিচালনা। ১৯৫৭ সাল। সেপাই বিদ্রোহের ঠিক একশো
বছর পরের সিনেমা।’
এটা ওদের একটা পুরনো খেলা। দুজনেই জানে ওটা ‘সপ্তপদী’ সিনেমার গান। দুজনেই জানে অন্যজন সেটা জানে। তবু নিখুঁত ডিটেইলসসহ ভুল সিনেমার নাম বলে, ভুল গায়কের নাম, ভুল ক্রিকেটারের
নাম বলে এই রকম একটা খেলা ওরা গত কয়েক বছর খেলে আসছে। স্টাফরুমে সকলের সামনে তর্ক করেছে। কেউ ধরতে পারেনি। মজা পেয়েছে সকলেই।
আজকের পর পৃথিবী থেকে এই খেলাটা হারিয়ে যাবে। ওরা ছাড়া আর তো কেউ জানে না এই খেলার খবর।
রাঢ়ভূমির এই মনমরা সন্ধেবেলাগুলোও অনিমিখের জীবনে হয়তো আর আসবে
না। মোরগমারি প্রসন্নবালা উচ্চ বিদ্যালয় তার জীবন থেকে আজ মুছে গেল। আগামীকাল সে এক নতুন স্কুলে যোগদান করছে। সেই স্কুল উচ্চ-মাধ্যমিক। সেখানে সে বেশি বেতন পাবে, অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী পাবে, টিফিনের সময় স্কুল থেকে বেরিয়ে এগরোল খেতে পারবে, বাইকের
পিছনে মিড-ডে মিলের আনাজ তাকে আর বয়ে নিয়ে যেতে হবে না হেডমাস্টারের
অনুরোধে । সবচেয়ে বড়ো কথা এই নতুন চাকরিটা তার বাড়ির একেবারেই কাছে। প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার ঝক্কিটা তাকে আর পোহাতে হবে না। সেখানে মাটির রঙ একটুও লাল নয়। যদিও এখান থেকে মোটে চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব, রাঢ়বাংলার কোনো আমেজ অনিমিখের ছোট শহরে নেই। নিজের শহরে একটা ছোট চাকরি নিয়ে জীবন কাটাতেই সে চেয়েছে। আর শুধু চেয়েছে প্রচুর প্রচুর কবিতা লিখে অনেক নাম করতে।
মিলন বলল, ‘বাঁকের কাছে হর্ণ দিয়ে চল। শেষ দিনটা আবার একটা ঝামেলা পাকাস না।’
অনিমিখ জোরে হেসে উঠল, ‘হর্ণ দিলে চাঁদ ডুবে যাবে।’
‘কী ?’
‘কিছু না। ওটা একজনের কবিতার লাইন। সত্তরের দশকের কবি। এরকম
অনেক চমকদার লাইন লিখেছে সে।’
‘ধুস ! নিজের কোনো লাইন বলতে পারতিস আজ। তোর কবিতা তো আর শুনতে পাবো না কোনোদিন। বই কিনে পড়তে হবে এবার। আর, এখানকার বই দোকানে তোর বই পাওয়াও যাবে না।’
অন্যদিন হলে এই খোঁচায় অনিমিখ সত্যিই রেগে যেতে পারত। আজ রাগল না। আজ সত্যিই অন্যরকম একটা দিন। সে গিয়ার কমাল। বাইকটা থামাল।
দুজনে নামল। সিগারেট ধরাল। মিলন আজকাল সিগারেট অনেকটাই কমিয়েছে। অনিমিখের আগের চেয়ে বেড়েছে। ফেরার পথে প্রতিদিন এইভাবেই একটা জায়গায় বাইক থামিয়ে তারা একসঙ্গে সিগারেট ধরায়। এই সময় অনিমিখ তার অনেক কবিতা মিলনকে শুনিয়ে ‘সাধারণ পাঠক’-এর মতামত নিয়েছে, এমনকি মিলনের কথায় কবিতায় কিছু বদলও করেছে। যদি মিলন সামন্ত নামক সহকর্মীটি না আসত, অনিমিখের জীবন কিছুটা হলেও অন্যরকম হত। আরেকটু তার নিজের মনের মতো হত, হয়তো তার কবিতার কিছু লাইনও।
সূর্যকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ময়লা অন্ধকার নেমে এসেছে। কিছু ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরে জঙ্গলের অনেকটাই ভিতরে কোনো গ্রামে শুয়োর মারা হচ্ছে। অনেক দূর থেকে সেই তীব্র শব্দ ভেসে আসছে। পৃথিবীর যেকোনো পোষা প্রাণীর তুলনায় শুয়োরকে মারা অনেক বেশি নিষ্ঠুরতার কাজ। চরম মৃত্যুযন্ত্রনা না দিয়ে একটা শুয়োরকে হত্যা করা যায় না। আর্তনাদে আকাশ ফেটে যায়। হত্যাকারীদের সারা গায়ে ঘাম ঝরে। মুখ থেকে হাসি ঝরে। কোনো এক বুদ্ধিমত্তা কোনো এক সময়হীন সময়ে প্রাণের সৃষ্টি
করেছিল। হয়তো চেয়েছিল ফাঁকা মহাবিশ্বে এই সুযোগে করুণার সৃষ্টি হবে। এই আর্তনাদ
অবিশ্যি এমন ধারণাকে টিকতে দেয় না।
আট বছর মোরগমারিতে চাকরি করেও শুয়োরের মাংস অনিমিখের খাওয়া হল না, এটা আফশোস।
জঙ্গলমহলে এতগুলো বছর কাটিয়ে তার শুয়োর খাওয়া হল না। বুনো হাতির সামনে পড়া হল না। হাঁড়িয়া পান করা হল না। একজন মাওবাদীর সঙ্গেও ‘রেড বুক’
নিয়ে কথা বলা হল না। আদিবাসী বাড়ির খাটিয়ায় শুয়ে একটিও পূর্ণিমার রাত কাটানো হল না। একজন বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায় তার চাকরিটায় থাকলে কী না করতে পারতেন এই জায়গাটাকে নিয়ে! আর কবি অনিমিখ চক্রবর্তী একজন ছাপোষা মাস্টার হয়ে এমন একটা বুনো জায়গায় আট বছর কাটিয়ে দিল ! কবিতায় লাল মাটির তেজ ফোটাতেও কি সে পেরেছে ! সন্দেহ আছে। ঘোরতর সন্দেহ আছে। মোরগমারি তাকে ব্যবহার করে নিয়েছে, সে মোরগমারির কোনো কিছুই ছিনিয়ে নিতে পারেনি, চেয়েও চুরি করতে পারেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চড়েছে। বাস থেকে নেমে বাইক। পিছনে মিলন। স্কুলে ভূগোল পড়িয়েছে। তারপর আবার বাইক। আবার মিলন। আবার বাস। আবার বাড়ি। বাড়ি বাস বাইক, বাইক বাস বাড়ি।
তার মধ্যেই কিছু বানিজ্যিক কাগজে বানিয়ে বানিয়ে লেখা মিষ্টি-মিষ্টি
কলকাতাগন্ধী কবিতা।
জঙ্গল থেকে দুজন মলিন মেয়ে বেরিয়ে এল। সতেরো-আঠারো বয়স হবে। পাতা কুড়িয়ে ঘরে ফিরছে। অনিমিখ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সিগারেটের হাল্কা ধোঁয়া ছাড়ছিল মুখ থেকে। এদেরও তার জানা হল না। একটিও আদিবাসী রমণীকে সে জানতে
পারেনি এই আট বছরে। আজ আর এখনকার মেয়েরা শুদ্ধ আরণ্যক নয়। অরণ্যের দিনরাত্রি বদলে গেছে। আজ এখানকার মেয়েরা স্কুলে পড়ে, কেবল টিভি দেখে, শাহরুখ খানকে
চেনে, দেব-শ্রাবন্তীর পোস্টার কেনে মেলায়
গিয়ে। তবু – রক্তটা তো আছে ! হয়তো সেই একই বুনো রক্ত...
‘ওভাবে তাকাস না! কতবার বলেছি তোকে? এখনই একটা
ঝামেলা হবে!’
মিলনের চাপা গলায় সংবিত ফিরল তার।
এটাই মিলন করে আসছে গত আট বছর। মিলন তার জীবনে না এলে এই আট বছর
তার এমন না-ও যেতে পারত। দুজনে একই দিনে চাকরিতে যোগদান করেছিল। যদি মিলন আরো কয়েকমাস বা কয়েকবছর পরে স্কুলে আসত, এখানে তার জীবনটা একজন ছাপোষা স্কুলশিক্ষকের না
হয়ে একজন দামাল কবির হতে পারত।
অনিমিখ হাসল। মিলনের পেটে তর্জনী দিয়ে একটা
খোঁচা মেরে বলল, ‘উন্মুক্ত স্তনের দিন তো শেষ
হয়ে এল মাস্টার! আর কেন?’ বলল না এটাও ওই কবিরই লাইন। হয়তো তার ফলে মিলন বেশি উপভোগ করবে। হেসে ফেলবে।
মিলন হাসল
না। তার মুখ একটু থমথম করছিল। অনিমিখের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোকে একটা কথা আজ বলব ভাবছি। সকাল থেকেই ভাবছি। বলতে পারছি না। আসলে বুঝতে পারছি না আজকের দিনটায় তুই কীভাবে নিবি। কিন্তু তোর বন্ধু হিসেবে কথাটা তোকে বলা আমার কর্তব্য মনে করছি। বিশেষ করে আর তো তোর সঙ্গে আমার ঘনঘন দেখা হবে না।’
অর্থাৎ এই শেষ দিনেও মিলন তার একটা দায় পালন করবে! একজন আদর্শ মাস্টারমশাইয়ের দায়! অনিমিখ
বিপন্ন বোধ করল। হয়তো মিলন এখন এমন একটা কথা বলবে, যা তাকে আর কোনোদিনই নিজের মনের মতো হতে দেবে না। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে অনিমিখ শুকনো হাসল, ‘তোকে তো বলাই আছে, তুই আমাকে
যে কোনো কথাই বলতে পারিস। সেই অধিকার তোর আছে। তবে সেটা মানবো এমন গ্যারান্টি আমি দিইনি কোনোদিন।’
‘তোর জীবনটা তোরই। আর, আমিও শোলের অমিতাভ বচ্চন নই। আমাদের মধ্যে অমন কোনো একতরফা কয়েন নেই, তাই না?’
‘আমার অনেক সময় অবিশ্যি মনে হয়েছে তোর পকেটে ওরকম
একটা কয়েন আছে। তুইই নাহলে সবসময় ঠিক হোস কী
করে?’
‘ছাগলের মতো কথা বলিস না। যদি কয়েনটা থাকেও, আজকের পর আর তো থাকবে না। ওটা ছিল বলেই তুই আজ মান
বাঁচিয়ে এখান থেকে অন্য স্কুলে যেতে পারছিস। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি তোকে
সামলেছিলাম বলেই, সামলাই বলেই, তোর বৌ তোকে আজও ছেড়ে যায়নি। বাড়ি ফিরে তোর বাচ্চাটার মুখ তুই আজ দেখতে পাবি।’
‘তাই?’
‘তাই। বর্ণালী প্রতিহারের কেসটা তাহলে ভুলে মেরে দিয়েছিস! স্কুলে ঢোকার
পর সেই প্রথম কয়েকটা মাস তোর মনে আছে? আমি কীভাবে তোকে আটকাতাম, মনে আছে? তোর তখন বিয়ে হয়নি। তোর সাধের প্রেমিকা তোকে ছেড়ে গেছে। ছাত্রীদের নিয়ে তুই সেই অভাব মেটাতে চেয়েছিলি। এখানকার গার্জেনরা অত কনশাস নয়, তাই বেঁচে গিয়েছিলি। আমিই তোকে সেভ করেছিলাম। নাহলে বর্ণালীর ঘটনাটার পরেই খবরের কাগজে তোর নাম উঠে যেত, কবি অনিমিখ চক্রবর্তী, ভুলিস না সেটা।’
‘ভুলিনি।’ অনিমিখ বুঝতে পারছিল মিলন
রেগে গেছে। মিলনের
কাঁধে হাত রেখে যথাসম্ভব কোমল গলায় বলল, ‘তুই আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলি। অন্য কারো চোখে পড়লে আমার লাইফ শেষ হয়ে যেত। সে-জন্য আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ।’
মিলন নরম হল, ‘ওটা কোনো কথা নয়। কিন্তু তুই কি আজও শুধরেছিস?’
‘শুধরে কি কেউ যায় নাকি? অভিনয়টা
চুটিয়ে করতে হয়! রিফর্মড ক্যারেক্টারের অভিনয়টা খারাপ করি বলে তো মনে হয় না আজকাল!’
‘খুব খারাপ করিস। অন্তত আমার চোখে। ছাত্রীদের গায়ে হাত দিতে তো
আজও ছাড়িস না ! নতুন স্কুলে গিয়ে শহুরে মেয়েদের
সঙ্গে কী করবি জানি না, কিন্তু এখনও তো বাসে উঠে মেয়েদের পিছনে
দাঁড়িয়ে যাস!’
জোর করেই হেসে উঠল অনিমিখ, ‘আরে, সে তো চুলের গন্ধটা শুঁকবো বলে! পৃথিবীতে দুটো মেয়ের
চুলের গন্ধ কখনও একই হয় না, জানিস তো? ফিঙ্গার
প্রিন্টের মতো আলাদা। যতই ওরা একই তেল মাখুক, একই কন্ডিশনার লাগাক, একই
শ্যাম্পু ইউজ করুক, চুলের গন্ধ মিলবে না।’
‘আর সেটা জানার জন্য একেবারে ওদের পিঠে গিয়ে পড়তে
হবে?’
‘অবশ্যই। পড়তে হবে। চড়তে হবে। এক্কেবারে
চার ঠ্যাং তুলে। হা হা হা হা…’
‘যদি কেউ ঘুরে একটা চড় কষায়? সাহিত্য আকাদেমি পেলেও কিন্তু সেই অপমানের দাগটা মুছবে না গাল থেকে!’
‘কেউ চড় মারবে না ভাই! ওরা এনজয় করে। আমি বেশ টের পাই।’
‘আমার তো মনে হয় তুই শুধু প্যান্টের জিপটা খুলতে বাকি
রাখিস! তোর সঙ্গে বাসে উঠতে ভয় করে আমার আজকাল।’
‘হা হা হা হা…’
‘হাসিস না অনিমিখ! শুধরে যা। তোর অনেক প্রতিভা আছে। কবি হিসেবে তুই অনেক দূর যাবি, আমার বিশ্বাস। কিন্তু তার আগেই হয়ত কোনো বিপদ ঘটাবি! এত সুন্দরী একটা বৌ আছে তোর, ফুটফুটে একটা বাচ্চা …’
‘ছাড়! আর এভাবে গিলটি ফিলিং দিস না। তোর কথাগুলো মনে থাকবে। তবে এই শেষ দিনটায় এসব না বললেই
পারতিস!’
মিলন চোখ সরিয়ে নিল। চাপা গলায় বলল, ‘সরি! কিন্তু না বলে পারলাম না। আফটার অল, তুই আমাকে
বন্ধু হিসেবে চিনিস। আমি এগুলো না বলে পারি না। তোর মতো আরো অনেকেই হয়তো
মেয়েদের ওই চোখে দেখে। তাদের জন্যই আজ মেয়েদের পথেঘাটে অপমানিত হতে হয়। সারা দেশেই
তো মেয়েদের উপরে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার চলছে। কিন্তু কোনো রেপিস্ট আমার কথা শুনবে
না। তারা আমার কেউ নয়। তুই তো আমার কাছের মানুষ!’
অনিমিখ আর হাসল না। ঠান্ডায় নাকের ডগাটা হিম হয়ে গেছে, কিন্তু তার কান একটু গরম হয়েছে। মিলন এইমাত্র কি তাকে
রেপিস্ট বলল? একটা প্রত্যাঘাত কি সে করবে? এই একটা আঘাতেই হয়ত মিলনের বিবেকের ভূমিকা তার জীবন থেকে সত্যিই সরিয়ে ফেলা
যায়, সরিয়ে ফেলা দরকার। সে আবার একটা সিগারেট ধরাল। শুয়োরটার আর্তনাদ আর শোনা যাচ্ছে না। সন্ধে পুরোপুরি নেমে এসেছে। ঝাঁঝালো বাতাস কনকন করছে ঠান্ডায়। অনেক বেশি ঝিঁঝিঁপোকা এখন ডাকছে। দূরে একটা আবছা মাদলের আওয়াজ। যে গ্রামে শুয়োর মারা হচ্ছিল, সেখান থেকেই হয়তো আসছে। হয়তো কোনো পরব আজ ওই গ্রামে।
ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাকের উপর যতটা গলা তোলা দরকার ঠিক ততটাই জোরে
অনিমিখ বলল, ‘আমিও তোকে একটা খবর দিচ্ছি
তাহলে। দেবো তো?’
‘কী?’
‘তোদের অন্বেষা ম্যাডামকে আমি কিন্তু নেবো।’
‘কী বলছিস? মানে কী?’
‘তোরা সবাই তো খুব আড্ডা মারিস ওর সঙ্গে! ইয়ার্কি মারিস! স্বপ্ন-টপ্নও নিশ্চয়ই দেখিস …’
‘কী বাজে বকছিস, একজন সহকর্মী
ও আমাদের …’
‘বাজে নয় ইয়ার! ও তোদের স্টাফরুমের
মক্ষীরাণী। তোদের হার্টথ্রব। সকলের সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, শুধু আমার সঙ্গে দূরত্ব রাখে। কিন্তু আসল কাজটা দেখিস আমিই করব! ওর আমি নেবো! একবার হলেও নেবো!’
‘এবার তুই নোংরা কথা বলছিস। আসলে ক্ষেপে গেছিস। বাড়ি চল।’
‘নোংরা কথা বলছি হয়তো, কিন্তু
মিথ্যে বলছি না। ওটা ঘটবে। তবে তুই জানতে পারবি না। তোকে আমি খবর দেবো না। আজ শুধু একটু ইশারা
দিলাম।’
‘বাড়ি চল। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।’
‘চল। কিন্তু কথাটা আমি বাজে বললাম না।’
দুজনে আবার বাইকে বসল। হাইরোড এখান থেকে চার কিলোমিটারের
মতো হবে। অনিমিখ হেলমেটটা পরে নিল। ঠান্ডা অনেকখানি আটকায় ওটা। উইন্ডচিটারটা গলা অবধি এঁটে নিল। বাইক চলতে শুরু করল। মিলন আর অনিমিখের কাঁধে হাত
রেখে বসেনি।
অনিমিখের খারাপ লাগতে শুরু করল। বাইক পিচরাস্তায় পৌঁছল। অন্যদিন তাদের বাইকযাত্রা এখানেই শেষ হয়। এখানে একটা দোকানে বাইক রেখে তারা বাস ধরে। আজ এই বাইক চিরকালের মতো বাড়ি ফিরছে।
মিলন একটাও কথা বলছিল না। অনিমিখও কিছু বলতে পারছিল না। বাইক অনিমিখের শহরে পৌঁছল। মিলনকে এখান থেকেও আরো কুড়ি কিলোমিটার দূরে তার গ্রামে যেতে হবে। বাস ধরবে সে এবার। বাসস্ট্যান্ডে এসে অনিমিখ স্টার্ট বন্ধ করল। মিলন নামল। দুজনেই চুপচাপ।
অনিমিখের এবার সত্যিই বাজে লাগছিল। মিলনের মুখটা কালো হয়ে আছে।
পাশের চায়ের দোকানে এফ এম রেডিওয় তারস্বরে হিন্দি গান বাজছে। অনিমিখ জোর করে হেসে বলল, ‘কিশোর কুমার দুর্দান্ত গেয়েছিল এই গানটা ‘ডিস্কো ডান্সার’ সিনেমায়! জবাব নেই শালা! একটা গায়কের মতো গায়ক ছিল লোকটা! আর কেউ হবে না অমন।’
মিলনও যেন চেষ্টা করেই হাসল, ‘হ্যাঁ। তবে ওই গানটা ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর নয়। ‘নমক হালাল’-এর। আসি। ভালো থাকিস। ফোন-টোন করিস।’
মিলন চলে গেল তার বাসের দিকে। পিঠে ব্যাগ। হাতে হেলমেট।
ওই হেলমেট ওর আপাতত কোনো কাজে লাগবে না।
ওই গানটা সত্যিই ‘নমক হালাল’ সিনেমার গান। মিলন সামন্ত খেলাটা শেষ করে গেল?
কে জিতল?
অনিমিখ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। স্কুল থেকে বেরিয়েই অন্বেষাকে মেসেজ করেছিল সে। এখনও উত্তর এল না।
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল অনিমিখের। হাতের বদলে পায়ে স্টার্ট করল বাইক।
বাড়িতে ফিরে যেমন আনন্দের পরিবেশ আশা করেছিল সেটাই পেল। রিয়া উদ্ভাসিত মুখে দরজা খুলল, যেন একটা নতুন জীবন সে খুলে দিচ্ছে বরের সামনে। চার বছরের মেয়ে সোনু এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে সে দেখল তার অসুস্থ মা-ও নেমে এসেছে আজ দোতলা থেকে। পাশের বাড়ির জ্যোতির্ময়বাবু এসে হাজির হয়েছেন। বসার ঘরের সবগুলো আলো জ্বলছে। খাবারের গন্ধ আসছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। প্রায় একটা ঘরোয়া পার্টির পরিবেশ।
মনটা ভালো হয়ে গেল অনিমিখের। এরা বোধহয় ধরে নিয়েছে বাড়ির কাছাকাছি এই চাকরি তাকে অনেক বেশি করে ঘরের মানুষ করে তুলবে, অনেক বেশি করে এরা পাবে তাকে, জঙ্গলমহলের কোন ভয় তাকে আর ছুঁতে পারবে না।
মেয়ে সোনুর জন্য চকোলেট আনতে সে ভুলে গিয়েছে। অবিশ্যি কেউ সেটা খেয়ালই করল না।
জ্যোতির্ময়বাবু হেসে বললেন, ‘এবার যত খুশি কবিতা লেখো অনিমিখ। অনেক সময় পাবে তুমি এবার। আর মা-বৌ-মেয়ের দেখাশোনা করো। আমার অনেক চিন্তা চলে গেল।’
অনিমিখ হাসল। সত্যিই এই প্রৌঢ়টি তার অনুপস্থিতিতে অনেক বিপদ সামলেছেন। মায়ের শরীর তো আজকাল খারাপই থাকে। ইনি প্রতিবেশী হিসেবে যেটা করেন, আশাই করা যায় না আজকাল। সেচবিভাগে চাকরি করেন। অবসরের সময় অবিশ্যি হয়ে এসেছে। বিপত্নীক। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর কানাডায় চলে গেছে। হয়তো রিয়ার মধ্যে সেই মেয়েকে ইনি খুঁজে পেয়েছেন, সোনুর মধ্যে কোনোদিন চোখে না দেখা নাতনিকে। কয়েকবার সোনুর অসুস্থতায় রাত অবধি জেগেছেন। অনিমিখ বরং ঘুমিয়ে পড়েছে।
আশ্চর্য মানুষ! বাড়ির সদর দরজায় জ্যোতির্ময়বাবু সচরাচর তালা দেন না। খিল দেন না। একমাত্র দূরে কোথাও গেলে তালা দিয়ে চাবিটা রিয়ার কাছে রেখে যান, হারিয়ে ফেললে যদি ফিরে এসে নিজের বাড়িতেই না ঢুকতে পান এই ভয়ে। বলেন ওঁর নাকি চুরি হওয়ার মতো কিছু নেই, চুরি করার জন্য সারা পৃথিবীটা আছে।
কোনোদিন হয়তো অনিমিখ ওঁকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে। হয়তো একটা উপন্যাস।
রাতের খাওয়া পর্যন্ত গল্পগুজব চলল। অনিমিখের মন পড়ে রইল মোবাইলের দিকে। তার অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করার প্রয়োজন কারও হল না। এক ফাঁকে মরিয়া হয়ে সে একই মেসেজ আবার পাঠাল – aar ki dekhaa hobe naa?
বহুদিন পর আজ সে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফোন স্যুইচড অফ করল না।
এই আনন্দের দিনেও বিছানাতে রিয়াকে সে বেশিকিছু দিতে পারল না। রিয়া নিশ্চয়ই সেটাকে ক্লান্তিই মনে করল। অনিমিখের উপরে কতখানি ধকল
যায়, সে জানে। একেকদিন ফিরে এসে আর ও বসতেও পারত না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ত। বিশেষ করে বর্ষাকালে, যখন
টানা স্কুল চলত।
মাঝরাতে জল খেতে উঠে দেখল উত্তর এসেছে – sir, eibhaabe ghono ghono message
korle aamar husband kichhu mone korte paare. any way, thumbs up for the new
school-life. ha ha ha... good night.