নতুন স্কুলে এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরে অনিমিখ বুঝল মাস্টারদের
আসলে একটাই সমাজ। স্কুল বড়ো হতে পারে, ছোট হতে পারে, মাস্টারদের কাজের চাপ বাড়তে পারে,
কমতে পারে, তাঁদের যাতায়াতের দূরত্ব কমতে পারে,
বাড়তে পারে, তাঁরা শহরবাসী হতে পারেন, গ্রামবাসী হতে পারেন, বিভিন্ন বয়সী হতে পারেন,
এমনকি নারী অথবা পুরুষ হতে পারেন, সকলেই শিক্ষকসুলভ
পোশাকও আজকাল আর পরেন না, কিন্তু তাঁদের দেখলেই চিনে নেওয়া যায়। প্রায় নির্ভুলভাবে বোঝা
যায় তাঁরা কোনো না কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অথবা মহাবিদ্যালয়ে পড়ান। অবশ্যই এই বিরাট সমাজটি বিভিন্ন উপ-সমাজে বিভক্ত। কিন্তু তাঁদের শনাক্ত করতে
সমস্যা হয় না। পেশা তাঁদের অলক্ষ্যে বদলে দেয়, ঠিক যেমন অন্যান্য পেশাগুলোও দেয়। একজন পুলিশকে, উকিলকে, ব্রোকারকে, অথবা ডাক্তারকে দেখলেই যেমন চিনে
নেওয়া যায়, অন্তত সন্দেহ হয় তিনি ওই কাজটিই
করেন।
কিছু মানুষ শিক্ষকতার পেশার মধ্যে থেকেই সাহিত্যে সোনার ফসল ফলিয়েছেন। ছাত্ররা তাঁদের দেবতা ভেবেছে, সারাজীবন তাঁদের স্মৃতি মনে রেখেছে। তাঁরা শিক্ষকতাকে চাকরি ভাবেননি, আবার নিজেদের শুধুমাত্র ‘মাস্টার’ ভেবে একটা ছকের মধ্যে আটকেও ফেলেননি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো একজন শিক্ষকই ছিলেন! এই পেশার মধ্যে না থাকলে তিনি ‘অনুবর্তন’-এর মতো উপন্যাস লিখতে
পারতেন কি!
কিন্তু অনিমিখ খুব ভাল করে জানে সে কোনদিনই মনেপ্রাণে একজন শিক্ষক হতে পারবে না। একটা ভয় তার মধ্যে সবসময় কাজ করে। নিজস্বতা হারিয়ে ফেলার ভয়। সেটাই হয়তো তাকে আর পাঁচজনের চেয়ে দূরে রাখে। আটকে রাখে।
সেটা কি অনিমিখের মাঝারিয়ানারই প্রমাণ? প্রবাদবাক্যের সেই মধ্যমের মতোই কি সে তফাতে রাখে নিজেকে? বাঁচিয়ে রাখে নিজের ছিটেফোঁটাগুলো? অনিমিখ ভেবেছে। কিন্তু খুব
বেশি ভাবতে চায়নি।
মোরগমারির মতোই এই নতুন স্কুলেও অবিশ্যি অনিমিখ নিজেকে বেমানানই
বোধ করছে। এই বিশেষ সমাজের অন্তর্ভুক্ত সে হতে পারেনি, হয়তো হতেও চায়নি কখনও। এই পেশার জন্য এক বিশেষ মানসিক ধাঁচ প্রয়োজন হয়, হয়তো সেটাকে আত্মনিবেদনও বলা চলে। তার সেটা নেই। নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে একটা ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে ওঠার তাগিদটাকেই সে এড়িয়ে চলে। স্কুলের বাইরে কেউই তাকে দেখে বুঝতে পারবে না সে একজন মাস্টারমশাই। এই কারণেই আগের স্কুলে তাকে উন্নাসিক ভাবা হত। সে স্টাফরুমে বসে থাকলে আড্ডা জমত না। কিছুদিন পরেই এখানেও হয়তো সেটা ঘটবে।
ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষক হয়ে ওঠা তার হয়তো হবে না এই জীবনে।
এই এক সপ্তাহের মধ্যে সত্যিই অনিমিখ মাস্টারমশাইদের সঙ্গে সম্পর্ক
তৈরি করায় মন দিতে পারেনি। এমনকি স্কুলের নামকরা লাইব্রেরিটিতেও
একবার উঁকি দিতে পারেনি। ক্লাস নিয়েছে। ক্লাসের ফাঁকে অন্বেষাকে মেসেজ করেছে, ফোন করেছে টয়লেটে লুকিয়ে, বা টিফিনে সেই একইভাবে নদীর পাশে গিয়ে।
সন্দেহ নেই এই স্কুলে অনিমিখকে আরো রহস্যময় মানুষ ভাবা হতে পারে। হয়তো ইতিমধ্যেই ভাবা শুরু করে দিয়েছেন অনেকে।
এমনকি অপছন্দও।
অন্বেষাকে সেটা বলতে সে হাসল, বলল, ‘এখানেও তো আপনি ওটাই করতেন। আমরা সকলে তাই আপনাকে ভয় পেতাম। কিন্তু আমাকে এত ফোন করছেন, মেসেজ করছেন, ওই স্কুলের কেউ নোটিশ করছে না?’
এখন অনিমিখ অন্বেষাকে ‘তুমি’ বলা শুরু করেছে। ফোনের নিষেধাজ্ঞাটা সে অন্বেষাকে জানায়নি। তাই বলল, ‘হয়তো লক্ষ্য করছে, কিন্তু তোমাকে যে ফোন করছি সেটা তো আর জানতে পারছে না!’
অন্বেষা হাসল, ‘হয়তো ভাবছে বাড়ির পাশের স্কুলে এসেও মাস্টারমশাইয়ের বৌয়ের জন্য খুউউব মন খারাপ করে, ওকেই ফোন করেন লুকিয়ে লুকিয়ে।’
‘ওকে ফোন করে তো কোনো লাভ নেই অন্বেষা! হয়তো মেযেকে পড়াচ্ছে, বা মায়ের সেবা করছে, বা স্নান করতে ঢুকেছে…’
‘সেগুলো বুঝি খুব খারাপ কাজ?’
‘খারাপ অবশ্যই নয়। ও আছে বলেই আমাদের সংসারটা চলছে। তবে ও বিরক্ত হতে পারে কাজের মধ্যে। কিংবা, বলবে স্কুল থেকে ফেরার পথে দেড় কেজি মুগডাল কিনে নিয়ে যেতে।’
অন্বেষা প্রান খুলে হেসে উঠল, ‘সে তো বলবেই! আপনি না কিনে নিয়ে গেলে কে কিনবে? আর যত্ন করে সেই ডালটা তো আপনার জন্যই রাঁধা হবে তাই না? কবিকেও তো খেতে হয়! শুধু মাস্টারমশাইদেরই আছে, কবির বুঝি খিদে নেই?’
‘আছে অন্বেষা। অন্যদের চেয়ে বেশিই হয়তো আছে।’
কথা বলার ভঙ্গিতে কথাকে পেরিয়ে গেল অনিমিখ। পেটের খিদেকে পেরিয়ে গেল। অন্বেষা চুপ করতে বাধ্য হল। ওই কথা এইভাবে বললে পৃথিবীর যে কোনো সুস্থ মেয়ে চুপ করে যায়। মিলন সামন্ত হয়তো এই সময় সাবধান করে দিত, হয়তো বলত মেয়েটা ফোনের ভিতর থেকে থাপ্পড় মারবে, কিন্তু সেটা হওয়ার নয়, কোনো মেয়ে সেটা করে বলে অনিমিখের মনে হয় না। দুজনের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের এই যে নীরবতা নেমে এসেছে, অনিমিখ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানে, এর পরে পর্দাটা আরো উঠবে। অনিমিখের বুক শান্তই ছিল। প্রায় এক অভিজ্ঞ প্লে-বয়ের মতো সে এগোচ্ছে এখন এই সম্পর্কটায়। এই তিন-চারদিনে তার চিত্রনাট্য একটাও অপ্রত্যাশিত মোড় পায়নি। সে জানে, সে টের পাচ্ছে, গভীর জলের মধ্যে একটা বিরাট মাছের
মতো অন্বেষাও তার চিত্রনাট্যের খেয়াল রাখছে, উপরের তলে ভেসে উঠতে চাইছে, রোদ্দুর মাখতে চাইছে সারা গায়ে।
অন্বেষা বলল, ‘আপনি কী চাইছেন আমার কাছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু আমি এবার করতেই পারি।’
উত্তরটা অনিমিখের তৈরিই ছিল। এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বলল, ‘সাহচর্য! সঙ্গ! বন্ধুত্ব! আমি খুব একা অন্বেষা।’
‘একজন বিবাহিত পুরুষ এই কথাটা বলার পরেই একজন মেয়ের কিন্তু ফোনটা কেটে দেওয়া উচিত!’
‘কিন্তু তুমি কাটছ না! এবং তুমিও বিবাহিতা! হয়তো একা, ঠিক আমার মতোই!’
‘পার্থক্য আছে, অনিমিখদা।’ অনেকখানি কষ্ট এসে মিশল অন্বেষার গলায়। এই প্রথম সে অনিমিখকে স্যারের বদলে অন্য সম্বোধন করল।
খুব কোমল গলায়, প্রায় আদরের মতো করে অনিমিখ বলল, ‘সত্যিই কি আছে? কোনো পার্থক্য? আমি তো টের পাচ্ছি না।’
‘কী করে পাবে? কতটুকু জানো তুমি আমার সম্পর্কে? কিছুই তো জানো না! আমি নামেই বিবাহিতা। কিন্তু তুমি … তুমি একজন সুখী স্বামী, একটা ফুটফুটে বাচ্চার বাবা। তুমি আমার সঙ্গে কেন জড়াতে চাইছ নিজেকে? খেলা? জীবন নিয়ে?’
অনিমিখ টের পাচ্ছিল তার কল্পনাকে এবার হারিয়ে দিচ্ছে অন্বেষা। মেয়েটা হয়তো নিজেই জানে না কখন ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছে তাকে। কিংবা খুব ভালো করে জানে।
তারই মতো রিহার্সাল করেছে আজ। তবে ঠিকভাবে রাশ না টেনে ধরলে এই মহামুহূর্তটি পিছলে গিয়ে অনিমিখের হাত ফাঁকা করে দেবে।
অনিমিখ বলল, ‘জীবন নিয়ে খেলা নয়। জীবনের চাহিদা।’
‘শরীর? সেটাই বলো।’
তীব্র গলায় বলল অন্বেষা, ‘সেই খিদেটার ইশারাই দিলে একটু আগে?’
এবার খুব তৈরি গলায় অনিমিখ বলল, ‘ছিঃ! এটা তুমি বলতে পারলে?’
টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে আসছিল। আজকাল হয়তো তার উপস্থিতির কারণেই নদীর দিকে ছাত্ররা সেইভাবে আসে না। দু-তিনজন ছিল। তারা স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছে। তার দিকে মাঝেমাঝে কৌতুহলের দৃষ্টিও দিচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক। এইভাবে নদীর ধারে রোজ রোজ এলে সকলেই সন্দেহ করবে। সমস্যাও হতে পারে স্কুলে।
অনিমিখ স্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বলল, ‘এটা তোমার কাছে শুনবো, ভাবিনি
অন্বেষা! কিন্তু এটাই বোধহয় বাস্তব! আমাদের সমাজে তো মন আর শরীরকে আলাদা করে ভাবা হয় না। একই মনে করা হয়। আমার সেভাবে ভাবার অভ্যাসটা নেই। তোমার থাকতেই পারে, আমার মনে রাখা উচিত ছিল।’
অন্বেষা উন্মুখ গলায় বলল, ‘তুমি রাগ করবে না কিন্তু! আমার খারাপ লেগেছিল তোমার খিদের কথাটা। কে নিজেকে খাবার ভাবতে চায় বলো?’
‘কেউ চায় না। আমি জানি কেউ চায় না। আমি তোমাকে খাবার ভাবি না অন্বেষা। আমি তোমাকে ঠিক নিজের মতো ভাবি, আরেকটা অনিমিখ, বা আমিই হয়তো আরেকটা অন্বেষা, একটা অন্যরকম শরীরে! কোনো জোর নয়, অন্বেষা, জোর তোমার উপর আমি খাটাবোই না, সেই অধিকারও আমার নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো, গত কয়েকটা বছর আমি শুধু তোমাকেই চেয়ে গেছি, অবিরাম। তুমি না থাকলে আমি ওই স্কুল ছেড়ে পালিয়ে যেতাম।’
‘পালিয়েই তো গিয়েছ! আছো কি আর আমার সঙ্গে!’
‘দূরে না এলে তোমায় হতো না পাওয়া! এখন রাখছি। রাতে কথা বলি? ফোন করব?’
‘ইচ্ছে হলে, কোরো। ও আজ নেই। কলকাতায় মিটিং করতে গেছে।’
‘বেশ। রাত্তিরে ফোন করছি তাহলে। সাড়ে আটটার পর। টাটা।’
‘টাটা।’
টিফিনের পরে তার আরো ৩খানা ক্লাস ছিল। অনিমিখ পড়ানোর সময় অন্যমনস্ক হয়ে রইল।
আজও অন্বেষা তার কল্পনাকে পেরোতে পারেনি। অবাক করে দিতে পারেনি তাকে। তবে কি নিজের জীবন নিয়ে যে খেলাটা অনিমিখ খেলছে, তার শেষে সে জানতে পারবে কল্পনা আর স্মৃতির মধ্যে আসলে কোনো ফারাক থাকে না? এই অনুভূতি থেকে সে তো বেরোতেই পারছে না যে, এই ঘটনাগুলো তার মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই ঘটে আছে! তার মনে হচ্ছে অন্বেষার প্রতিটি সাড়া সে চিনতে পারছে, প্রায় একটা সেক্সি পুতুলের মতো সে নাচিয়ে চলেছে মেয়েটাকে!
কোনো বাধা নেই।
যেটুকু বাধা আসছে, তা নিজের সঙ্গে দাবা খেলার মতোই।
এতে তার জয় কোথায়? একজন চরম নিঃসঙ্গ মেয়েকে মিষ্টি একটা সম্পর্কের লোভ দেখালে, খুব মর্যাদার সঙ্গে ফুসলানি দিলে, সে তো এভাবে সাড়া দেবেই! সেটা যে শুধু মেয়েটির শারীরিক পিপাসা, তা-ও ভেবে নিয়ে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ খুব বেশি নেই।
ঠিক যেমন সুযোগ নেই এই খেলা শুরু করে এখন আর বন্ধ করার।
খেলাটা তাকে চালাতে হবে, একটা অপ্রত্যাশিত পয়েন্ট লক্ষ্য করে, যেখানে তার কল্পনা তাকে নিয়ে যেতে পারবে না।
শালা, কল্পনাকে হারতেই হবে তার কাছে।
বাড়ি ফিরে দেখল সবাই মিলে টিভিতে সিনেমা দেখছে। মা আজও নিচে নেমে এসেছে। অমিতাভ বচ্চনের ‘হাম’ চলছে একটা চ্যানেলে। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, যখন এই সিনেমা বেরিয়েছিল, অনিমিখ তখন কিশোর। তখন এই সিনেমার নামও তাদের মুখে আনা চলত না। ‘জুম্মা চুম্মা দে দে’ গানটাই ছিল তার কারণ। আজ সময় সত্যিই বদলে গেছে। তার মেয়ে আজ বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে এই সিনেমাটা দেখছে।
পোশাক বদলে এসে অনিমিখও বসল সিনেমাটি দেখতে। জ্যোতির্ময়বাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় এই ফিল্মটা খুব দেখতে চাইতাম, বাবা-মা-র ভয়ে দেখতে পারিনি। এরকম আরেকটা ছবিও দেখতে পারিনি- রামগোপাল ভার্মার ‘রঙ্গীলা’। বন্ধুরা লুকিয়ে দেখেছে। তাদের মুখে গল্প শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে।’
জ্যোতির্ময়বাবু হেসে উঠলেন, অনিমিখের মাকে বললেন, ‘শুনছেন তো, সন্তানের কত অভিযোগ থাকে, কিশোরবেলায় তাদের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করায়?’
মা-ও হাসল, ‘তখন সময় আলাদা ছিল। আজ তো সোনুও আমাদের সঙ্গে বসে আছে দেখুন, ওর মা আপত্তি করছে না।’
রিয়া বলল, ‘আপত্তি করলেই ও শুনবে নাকি? তাহলে তো এই ছবি বন্ধ করে কার্টুন নেটওয়র্ক চালাতে হবে!’
জ্যোতির্ময়বাবু বললেন, ‘আসলে সত্যিই সময়টা আলাদা হয়ে গেছে। এখন সন্তানরাই শাসন করছে বাবা-মাকে। সেটাই মনে হয় না? তাদের ইচ্ছেতেই চলছে পরিবারগুলো, মানে যে পরিবারগুলো আজ আর একান্নবর্তী নেই। সেখানে তো আজ আর বলার মতো কোনো ফাদার-ফিগারও নেই আগের মতো! একেবারের প্রথম থেকেই বাচ্চারা বুঝে ফেলছে তারা তাদের পরিবারের চোখের মণি, তাদের একটু চোখের জলও কেউ সইতে পারবে না। আমাদের বেলায় এটা ছিল না। নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে বুঝতেই পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসে পড়ত।’ একটু থামলেন উনি। তারপর আবার বললেন, ‘তবু কোথাও আমরা পুরোপুরি বদলাতে পারিনি নিজেদের। ফেসবুকের যুগে এসেও কিছু ব্যাপারে অনড় রয়ে গেছি। অথচ সেগুলোই বদলানোর দরকার ছিল।’
অনিমিখ বেশ মন দিয়ে শুনছিল ওঁর কথা। জিজ্ঞাসা করল, ‘যেমন?’
‘যেমন আমরা আজও বিশ্বাস করতে পারি না মানুষ বহু সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়েই বাঁচে, বাঁধা সম্পর্কের
বাইরে গিয়ে বাঁচে। সে ঠিক ফাঁক খুঁজে নেয়। তাকে আটকে রাখা যায় না। আটকে রাখলে সে বাঁচে না। মানুষ হয়ে বাঁচে না। পুতুল হয়ে যায়।’
অনিমিখ হাসল, ‘সকলে এটা বলতে পারে না। সকলে কি পারে বাড়ির সদর দরজায় খিল না লাগিয়ে রাত্তিরে ঘুমোতে?’
‘সেটাই যদি না পারে, তাহলে আর কী সভ্যতার বড়াই?’
‘সভ্যতায় বড়াইয়ের সুযোগ আর কই? লড়াইয়ের সুযোগটাই বেশি নয় কি?’
‘দারুন বলেছ অনিমিখ! চ্যাপলিনের সেই সিনেমাটা মনে পড়ে গেল। মঁসিয়ে ভের্দু। শেষ দৃশ্যে চ্যাপলিনের সংলাপটা মনে আছে তোমার?’
‘আছে। বোতাম টিপে যারা হাজার-হাজার মানুষকে মেরে ফেলে তারা রাষ্ট্রনায়ক, আর বেঁচে থাকার জন্য যে মানুষটা হত্যা করে অন্য মানুষকে, সে হয় খুনী। খানিকটা এরকমই বোধহয় বলেছিলেন উনি।’
‘কিয়েসলওয়াস্কির ‘এ শর্ট ফিল্ম এবাউট কিলিং’ … সেখানেও প্রায় একইরকম ব্যাপার, তাই না? হত্যাকারী ছেলেটিকে যখন টেনে হিঁচড়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে … উফ! কী বীভৎস! আমি দ্বিতীয়বার আর ছবিটা দেখার সাহস করিনি। যেমন স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘এ ক্লকওয়র্ক অরেঞ্জ’ দেখতেই পারিনি আমি কিছুটা এগনোর পর। এটা কখনো ভেবেছ, আমাদের এখানে সিনেমায় ভায়োলেন্সকে তবু অনেকখানি ছাড় দেওয়া হয়, যৌনতাকে সেইভাবে জায়গা দেওয়াই হয় না? অথচ, দ্যাখো, হিংসার চেয়ে অশুভ কিছু আছে কি? ওটা তো মানুষকে মানুষ রাখে না! ধর্ষণ কিন্তু যৌন অপরাধ নয় আমার মতে, ওটা হিংসা থেকেই ঘটে। দিল্লির ওই যে তরুণীটির
সঙ্গে কিছু ছেলে যেটা করল, ওটাই দ্যাখো। ওরা কি কামুক, নাকি হিংস্র? কাম যতই প্রথম রিপু হোক, সে মানুষকে সুন্দর করে, কুশ্রী করে না। বিদেশের ইরোটিক সিনেমাগুলো দেখলে সেটা বোঝা যায়। যেমন বৈষ্ণব পদাবলী পড়লে জানতে পারি ‘ব্যভিচার’ আসলে একটা নকল শব্দ। ওটা আসলে ‘ব্যতিক্রম’ হবে।’
অনিমিখ আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাল। মা কানে কম শোনে আজকাল। অবিশ্যি সেটা খেয়াল করে জ্যোতির্ময় শেষের কথাগুলো বলেননি। উনি অত হিসেব করে কথা বলেন না। মেয়ের কাছাকাছি বয়সী অনিমিখের কাছে চেয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাতে ওঁর বাধে না। শোনা যায় একসময় গাঁজা খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেন। বাড়ির লোক গিয়ে
তুলে আনত। আজ অবিশ্যি ওঁর বাড়িতে তুলে আনার কেউ নেই। অনিমিখ বা রিয়াকেই যেতে হবে।
তবে এখন আর ওসব উনি করেন না। মুখে মৃদু মদের গন্ধ অবিশ্যি প্রায়ই পাওয়া যায়।
অনিমিখের সঙ্গে কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। ছুটির দিন ছাড়া এর আগে সুযোগ পেতেন না, এবার পাবেন। অনিমিখও নিজেকে সমৃদ্ধ বোধ করে এই লোকটির সঙ্গে আলোচনার পর। একটি ছোট শহরে থেকেও, লেখালেখি বা সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কোনোরকম প্রত্যক্ষ লেনদেন না রেখেও সেচ বিভাগের সাধারণ কর্মচারী জ্যোতির্ময় হালদার নিজেকে কী করে তৈরি রাখেন এই ধরণের আলোচনার জন্য? ওঁর বাড়িতে অবিশ্যি বইয়ের শেষ নেই। সিনেমা আর গানের সিডির ইয়ত্তা নেই। এই শহরে ইন্টারনেট ব্যক্তিগতভাবে উনিই প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। এখনও নিয়মিত ফেসবুক করেন। ওঁর বন্ধুতালিকায় কলকাতার অনেক বিরাট-বিরাট নাম আছেন। অথচ নিজে জীবনে কিছু লেখার বা তৈরি করার চেষ্টা করলেন না!
হয়তো ওঁর চেয়ে অনেক কম ক্ষমতা নিয়েও অনিমিখ আজ কবি হিসেবে নাম কিনেছে, শুধু ইচ্ছের জোরে।
এভাবেও বলা যায়, অনিমিখ নিজেকে কবি হিসেবে কল্পনা করেছে সেই কৈশোর থেকে, আজ সে তাই বিভিন্ন নামী পত্রিকার সূচীপত্রে নিজের নাম দেখতে পাচ্ছে। নাম কি আর সত্যিই অত
দামি!
জ্যোতির্ময়বাবু চলে যাওয়ার পর সে কম্পিউটারের সামনে বসল। কিছু মেলের উত্তর দিল। কয়েকটি মেল করল। একটি আন্তর্জাল পত্রিকাকে কবিতা পাঠাল। এইসব শেষ হতেই ঘড়িতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। রিয়া কফি দিয়ে গেল। সেটা শেষ করে রাস্তায় বেরোল। আগে বারমুডা পরেই বেরনো চলত, এখন আর সেটা হবে না, সে এখন স্থানীয় শিক্ষক। যে কোনো মুহূর্তে টিউশন পড়তে যাওয়া কোনো ছাত্রের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। এখন আর অনিমিখ স্থানীয় কোনো সিডি শপে পর্নোগ্রাফি কিনতে পারবে না। সিগারেট যে কোনো দোকানে কেনা যাবে না। মদ তো এই শহরে আর কেনাই যাবে না।
বাইরে বেশ ঠান্ডা। শীতকালের এই সময়টা গোয়েন্দা গল্পের স্মৃতি মনে এনে দেয় অনিবার্যভাবে। খোলা মেজাজে অন্বেষার নম্বর লাগাল অনিমিখ।
স্যুইচড অফ!!!
পরের প্রায় এক ঘন্টা অনিমিখ রাস্তাতেই থাকল। বার পঞ্চাশেক অন্বেষার নম্বর লাগাতে চেষ্টা করল। প্রতিবারই স্যুইচড অফ শোনা গেল।
তবে কি ওর বর ফিরে এসেছে?
নাকি, ও পিছিয়ে গেল? সেটাই কি বুঝিয়ে দিচ্ছে এভাবে?
তবে কি অনিমিখ চক্রবর্তীর কল্পনার দৌড় এখানেই শেষ? বাকিটা খোশখেয়াল ছিল?
ঝোড়ো মন নিয়ে অনিমিখ বাড়ি ফিরল। রাতের খাবার খেল।