১২শ অধ্যায়



রাতে অনিমিখ আর থাকতে পারল না। মিনতির সুরে রিয়াকে বলল, ‘ক্ষমা কি করা যায় না?’
আশা করেনি, কিন্তু রিয়া উত্তর দিল, প্রায় শোনা যায় না এমন গলায়, ‘ক্ষমার কী আছে?’
‘বুঝতে তো পারছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারছ না!’
আর কোনো উত্তর আসেনি পাশবালিশের ওপাশ থেকে।
সারারাত অবিশ্যি ঘুমোয়নি অনিমিখ। রিয়া ঘুমিয়েছে হয়তো, কারণ এরপর ওর আর কোনো নড়াচড়া ছিল না। শুয়ে থেকে আকাশপাতাল ভাবা ছাড়া আর কী করতে পারত অনিমিখ! তাই সে একটা খেলা শুরু করল। অন্বেষার শরীরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার খেলা।
যতখানি উত্তেজকভাবে হতে পারে, অন্বেষাকে কল্পনা করতে শুরু করল সে। সিনেমার নায়িকাদের সঙ্গে মিলিয়ে, পর্ণ ছবির মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়ে, বিভিন্ন খোলামেলা পোশাকে, বিভিন্ন রুচিশীল পোশাকে, শুধু অন্তর্বাসে, এমনকি কোনোকিছু না পরিয়ে... সে ভাবল মেয়েটিকে। সেইসঙ্গে খেয়াল রাখল নিজের যৌন উত্তেজনার দিকে।
উত্তেজিত না হতে সক্ষম হল সে। একবারের জন্যও শরীরে কোনো পরিবর্তন হল না!
এ কি পরম আশ্চর্য নয় ! আশ্চর্য তাহলে কাকে বলে?
কল্পনা করল সমুদ্র থেকে দৌড়তে দৌড়তে উঠে আসছে অন্বেষা। খালি গা। উত্তাল ঢেউগুলোর সামনেমুখে বো ডেরেকের মারাত্মক হাসি।
অনিমিখের শরীর শান্ত রইল।
কল্পনা করল জঙ্গলে অন্বেষা তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। গাছের আড়াল থেকে দেখাচ্ছে নিজের দেহের খোলা অংশগুলো
অনিমিখের শরীর নিস্তরঙ্গ রইল।
এমনকি কল্পনা করল তার সামনেই অয়নের সঙ্গে তুমুল সেক্স করছে অন্বেষা। হি হি করে হাসছে তার দিকে চোখ রেখে।
অনিমিখের একটুও ক্রোধ হল না


সকালে উঠে অনিমিখ দেখল না-ঘুমোনো রাত তাকে কিছুই ক্লান্ত করেনি। অন্বেষার সামনে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।
কিন্তু স্কুল? না বলে আর তো ছুটি নেওয়া চলে না!
একটাই পথ আছে।
অনিমিখ নিরঞ্জন মাহাতোকে ফোন করল, এবং অতি ক্লিষ্ট স্বরে জানাল তার ডায়েরিয়া হয়েছে, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, এমনিকি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার শক্তিটুকুও নেই। নিরঞ্জন সম্ভবত বলার কিছু খুঁজে না পেয়ে ফোন কেটে দিলেন। হয়তো বাথরুমে ছিলেন! হয়তো বাজারে যাওয়ার তাড়া আছে!
সে যাই হোক, আগামীকাল স্কুলে তাকে আর অপদস্থ হতে হবে না।


বারোটা নাগাদ বাইক নিয়ে বেরোল।
আজ সকাল থেকে ঘন কুয়াশা হয়েছিল। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল রাস্তাঘাট। এখনও তার রেশ আছে। কিন্তু রোদ চড়েছে। কুয়াশার থেকে যখন রোদের পাল্লা ভারি হয়, তখনই শীত অপূর্ব হয়ে ওঠে। বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে।
এই বেড়ানোর ইচ্ছের সঙ্গেও কি পরকীয়ার মিল নেই? নিজের পরিচিত লোকটার বদলে অন্য একজন মানুষের মধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে আসার লোভ থেকেই হয়তো পরকীয়ার জন্ম হয়! শারীরিক খিদেটা তো তারপরে! যেমন শরীরের কারণেও অনেকে বেড়াতে যান। কিছু অসুস্থতার জন্য হাওয়া বদল প্রয়োজন হয়। বেড়াতে গিয়ে তো ঘরের জন্য মনকেমনটাও লেগে থাকে। বেড়িয়ে ফিরে আসার স্বস্তি বেড়ানোর আনন্দের চেয়ে বেশি মনে হয় অনেকের
মানুষের অনেক পাগলামি বেরিয়ে আসে একঘেয়েমি থেকে। একঘেয়েমিটা একবার টের পেলেই মানুষ হাত-পা ছুঁড়ে বেরোতে চায়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি জমাতে চায়। ধারালো পাপের লোভে বোকার মতো ভোঁতা অন্যায় করে বসে।
রিয়া আজও সকাল থেকে কথা বলেনি। কিন্তু ওর আচরণে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ‘ক্ষমা’ শব্দটায় একটা জাদু তো আছেইমানুষ চেষ্টা করেও ওই শব্দটাকে সহজে উড়িয়ে দিতে পারে না। শব্দটাকে ভাবতে বাধ্য হয়।
আজ ধীরে ধীরে বাইক চালাচ্ছে অনিমিখ। চল্লিশের উপর গতি নিয়ে যাচ্ছে না। লাল মাটি শুরু হওয়ার পরে তার বুক একটু কাঁপতে শুরু করল।
সত্যিই পারবে তো অন্বেষার সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু বলে বেরিয়ে আসতে? একটা সম্পর্ককে শুধু কিছু কথা বলে শেষ করে দেওয়া... পারবে তো আদৌ? নাকি আরো জড়িয়ে পড়বে সে আজ? আজকের পরে তার ফেরার রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে যাবে না তো? রাতে সে অন্বেষাকে যেভাবে কল্পনা করেছে, সেটাই যে ঘটবে তার তো মানে নেই! ওই কল্পনাগুলোয় সিনেমা ছিল, পর্নোগ্রাফি ছিল, ফ্যান্টাসি ছিল, অন্বেষা ছিল না। নিজের কল্পনাশক্তি তাকে আগেই ডুবিয়েছে। আবার যদি ডোবায়?
যদি কোনো অভাবনীয় রূপে অন্বেষা আজ তার সামনে আসে, আর সে নিজেকে আটকাতে না পারে?
হয়তো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দরজা খুলল, রাস্তায় কেউ থাকতে পারে, কেউ দেখে নিতে পারে, তার পরোয়া না করেই! তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিল বাড়ির ভিতরে, সোজা নিয়ে গিয়ে ফেলল বিছানায়, মুখ খোলার সুযোগই দিল না...
নিজেই তো বলেছে আজ অনেক শোধ তোলার আছে!
অনিমিখ টের পেল সে ঘামতে শুরু করেছে!
ঘাম কেন? সে কি এখনই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে?
ওগুলোই কি সে চাইছে আসলে?
তবে কি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো? বাড়ি ফিরে যাওয়া?

ছিন্নমস্তার মন্দিরটি এখন যেন অনেক দূরে! মূর্তিটির কোনো আদল তার চোখে আসছে না!

বাইক থামাল অনিমিখ। নেমে পেচ্ছাপ করল। শরীরে কোনো উত্তেজনার চিহ্ন নেই। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে একটা সিগারেট ধরাল।
সামনে একটা বিরাট গর্ত। অনেকখানি জায়গা জুড়ে মানুষই কেটেছে সেটাকে। সরকারি উদ্যোগে এরকম কিছু পুকুর এই অঞ্চলে খনন করা হচ্ছেএখন শুকনো। বর্ষাকালে অবিশ্যি কানায় কানায় ভরে যাবে। সেই জল জমা থাকবে চাষের জন্য।
এখন শুকনো গর্ত আশপাশের মাটির থেকে অনেক বেশি লাল হয়ে আছে।
কোনো লোকজন ধারেকাছে নেই। মাঝেমধ্যে একেকটি বাস অথবা লরি সবেগে চলে গেলে স্তব্ধতা নষ্ট হচ্ছে। সেটা বাদ দিলে আওয়াজ বলতে দূরে কিছু কুকুরের হাল্কা ডাক।
শালবনও হাল্কা কুয়াশাই জড়িয়ে রেখেছে গায়ে।
কয়েক মাস আগেকার অনিমিখ হলে এখানে দাঁড়িয়ে কবিতা ভাবার চেষ্টা করত।
সিগারেট টানতে টানতে অনিমিখ গর্তটার ধারে গিয়ে বসল।
কী করতে পারে সে এখন? ফিরে যেতেই পারে। তাতে ক্ষতি হয়তো কারও হবে না। বরং কিছু মানুষের জীবন আরো সুরক্ষিত হবে। অন্বেষা কি কষ্ট পাবে? মানসিক কষ্ট, নাকি শারীরিক? হয়তো দুটোকে এমন একটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে আলাদা করাই যায় না। সে নিজের ক্ষেত্রেও আলাদা করতে পারেনি। তাদের সম্পর্কের মধ্যে সেক্স ছাড়া তো কিছু আসেনি সেভাবে! অন্বেষার গান শুনতে তার ইচ্ছে করেনি। অন্বেষা তার কবিতার বই একবারের জন্যও পড়তে চায়নি। অবিশ্যি সে কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ায় অন্বেষা নিজেকে অপমানিত বোধ করেছিল। একটা ভয় মেয়েটার আছে, তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনিমিখের জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হয়তো সেটা নিজেকে দায়ী করে ফেলার ভয়। অনিমিখের মঙ্গলচিন্তা অতখানি নয়।
সবকিছু জেনে অয়ন যদি অনিমিখকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিত, কিন্তু নিজের বৌকে ক্ষমা করে দিত, অন্বেষা কি মেনে নিত না?  অনিমিখ ওর বরের হাতে খুন হলে অন্বেষা আত্মহত্যা করত কি?
সেটা অসম্ভব বলেই মনে হয়।
ও আজও অনিমিখের মেয়ের নাম জানে না। অনিমিখের জন্ম-তারিখ জানে না অনিমিখ জানে না অন্বেষার বাবা-মার নাম। ওর প্রিয় খাবার। ওর সবচেয়ে কষ্টের দিন। আনন্দের মুহূর্ত।


তবু, আজ যেতে হবে। কাপুরুষের মতো পালানো যায় না। এবং ফিরে আসতে হবে। সববিছু বলে। একটা স্থায়ী পূর্ণচ্ছেদ রেখে। কমা ড্যাশ বা সেমিকোলন নয়।
সে উঠে দাঁড়াল।
এবং ফোনটি বেজে উঠল নিস্তব্ধ বনের মধ্যে।
অন্বেষা!
একেই কি সমাপতন বলে! কাকতালীয় যোগ!
কিন্তু ফোন কেন! এই প্রথম অন্বেষা তাকে মিসড কল না দিয়ে, মেসেজ না করে ফোন করছে!
‘বলো!’
‘শোনো, তুমি আজ এসো না।’
অন্বেষার গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ। অনিমিখ টের পেল সঙ্গে সঙ্গে তার গলা শুকিয়ে গেল। পাথরটা আবার বুকে উঠে আসতে চাইছিল। ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে সে বলল, ‘কেন? কী হয়েছে আবার? আমি তো কাছাকাছি এসেই পড়েছি!’
‘ফিরে যাও। এর মধ্যে অনেক গোলমাল হয়েছে। ওর ব্যবসায় শত্রু বেড়েছেওর ধারণা তোমার সেই নম্বর তাদের কারো। ব্যাপারটা ও সহজে ছাড়বে না। থানায় ডায়েরি করতে না পারলেও একজন প্রাইভেট গোয়েন্দার হেল্প নিচ্ছে। কী সব নাকি জানতে পেরেছে!’
‘বলো কী! কিন্তু তুমি যে বলেছিলে ও আর ওটা নিয়ে ভাবছে না!’
‘সেটাই জানতাম আমি। কিন্তু ও একটু আগে বেরোল। তার আগে একটা ফোন এল। সেই গোয়েন্দার ফোন। অনেকক্ষণ কথা চলল। আমি কথাবার্তা শুনে এটাই বুঝলাম।’
‘তাহলে তো সর্বনাশ!’
‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমাদের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমার সঙ্গে ওর আচরণ এখনও স্বাভাবিক। তবে একটা ব্যাপার, তুমি অন্তত কয়েক মাস আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো না। আমিও সেটাই করব। ফোনে আর আমাদের কথা না বলাই ভালো। মেসেজও না। প্লিজ নিজের যত্ন নিও। ভাল থেকো। আমার জন্য ভেবো। গতকাল থেকে খুব খুউউব মিস করছি তোমাকে। কিন্তু... রাখছি। টাটা।’
ফোন কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনিমিখ রাগে মাটিতে একটা লাথি মারল। কিছুটা লাল ধুলো উড়ল। আহত জায়গাটা আশপাশের চেয়ে লাল হয়ে গেল।
আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হল তাহলে! সেই বিষ্ণুপুরে পালানোর আগের সময়টাই আবার ফিরে এল! আবার সেই উদ্বেগ নিয়েই দিন কাটাতে হবে তাকে। আবার খাদের কিনারা থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে হবে নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে।
না !
হঠাৎ তার খেয়াল হল এই পুরো ব্যাপারটার একটা দিক সে ভাবেইনি আজ অবধি। অয়ন তার বৌয়ের ফোনে অনিমিখের একটা মেসেজ পেয়েছে। সহকর্মীর ফোনে সহকর্মীর নম্বর থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। এবং ওই মেসেজ তো সে ভুল নম্বরেও করে থাকতে পারে! হয়তো নিজের বৌকে একটা রোমান্টিক মেসেজ করতে গিয়ে সেটা চলে গেল অন্বেষার কাছে!
এ তো হামেশাই হচ্ছে!
এর জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হতে পারে না!
একমাত্র অন্বেষা যদি সবকিছু বলে দেয়, তখন অপরাধের প্রশ্ন আসবে। সেটার সম্ভাবনা তখনই বাড়বে, যখন অন্বেষার সঙ্গে সে এভাবে যোগাযোগ রেখে চলবে। একটা বেচাল হলেও অয়ন সন্দেহ করতে পারে। চেপে ধরতে পারে বৌকে। সব কিছু তখন হয়তো উগরে দেবে মেয়েটা
তখন আর বাঁচোয়া নেই। সে বাঁচবে না, অন্বেষাও মরবে। একজন হিংস্র মানুষকে বিশ্বাস নেই।
অনিমিখ ফোনটা খুলে ফেলল। সিমকার্ডটা বের করল। আঙুলের চাপে সেটাকে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিল টকটকে লাল গর্তটির মধ্যে।
কত সহজে একটা মানুষকে জীবন থেকে মুছে ফেলা যায়!

সে কি ক্যাসানোভার মতোই চতুর এক মায়েস্ত্রো  নয় আজ?

বাড়ি ফেরার পথে নিজেকে সত্যিই নির্ভার লাগছিল অনিমিখের।
হেলমেটের আড়াল থেকে পৃথিবীকে মধুপুর মনে হচ্ছিল তার। শহরে ঢোকার মুখে পুলিশের একটি জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা হেলমেটহীন বা পায়ে বুটজুতো পরে নেই এমন কিছু বাইক-আরোহীকে ধরার জন্য রোজ দাঁড়িয়ে থাকে এখানে। অন্যদিন অনিমিখের একটু বুক কাঁপে। বলা যায় না হয়তো কোনো জরুরি কাগজ তার কাছে নেই! বলা যায় না হয়তো বাইকের দুটি চাকার হাওয়া ঠিক অনুপাতে নেই! হাতে দস্তানা নেই। একটু দ্রুতই সে পেরিয়ে যায় এই জায়গাটা।
আজ সময় নিয়ে পেরোল।
আজ তার ভয়কে অস্বীকার করার দিন।
শিদ দিতে দিতে বাড়িতে ঢুকল।
সকালের কুয়াশার দৌলতে একতলার মেঝে এখনও স্যাঁতসেঁতে। পা রাখলে ভিজে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে।
সিমেন্টের মেঝেতে আর চলে না, সে ভাবল। এবার টাইলস বসিয়ে নিতে হবে। বাড়িতে নতুন করে রঙ করাও দরকার। কেমন যেন মনখারাপের আবহ তৈরি হয় পুরনো রঙে! দরজা-জানালার পর্দাগুলোও কয়েক বছরের পুরনো। বদলানো দরকারস্কুলে বেতনটা চালু হয়ে গেলেই এই কাজগুলো সেরে নিতে হবে।
একতলায় কেউ নেই।
মায়ের ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
দোতলায় গেল। মা সোনুকে গল্প শোনাচ্ছে। তাকে দেখে থেমে গেল, মুখ ফিরিয়ে নিল নাতার মানে মায়ের রাগ একটু হলেও কমেছে।
অনিমিখ নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল,‘তুমি কি বাড়িতে একা নাকি?’
মা আস্তে আস্তে বলল, ‘একা কোথায়, সোনু তো আছে আমার সঙ্গে! তাই না মামণি?’
সোনু সোল্লাসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।
অনিমিখ অনাবিল হেসে বলল, ‘তাহলে তো আর চিন্তাই নেই! কিন্তু ওর মা কোথায়? রিয়াকে দেখছি না!’
‘বৌমা তো জ্যোতির্ময়বাবুর বাড়িতে গেল একটু! শুনলাম ওঁর জ্বর এসেছে। ওকে আমিই পাঠালাম।’
অনিমিখের নিজেকে দুর্বল মনে হল। যে দিনগুলোয় সে ছিল না, মায়ের দেখাশোনা করেছেন ভদ্রলোক। কয়েকদিন রাতও জাগতে হয়েছে ওঁকে। নিজের পাগলামিতে সে ভুগিয়েছে একটি বয়স্ক মানুষকে। উনি হয়তো তাতে অসন্তুষ্ট হননি, কিন্তু তাতে অনিমিখের ত্রুটি কমে না
সে বলল, ‘আমিও তাহলে একবার যাই। দেখে আসি কেমন আছেন।’
মা খুশি হল, ‘যা। যাওয়াটা উচিত।’

কী সাধারণভাবে এই মানুষটা তাঁর জীবনটাকে কাটালেন!
জীবনটা কিন্তু ঠিক অতটা সাধারণ ছিল না জ্যোতির্ময়ের ওঁর বাড়ির দিকে যেতে যেতে অনিমিখ ভাবল। কতজন মানুষ পারেন নিজের বয়স এবং অশক্ত শরীরের পরোয়া না করে রাত জেগে প্রতিবেশীর বাড়িতে এক বৃদ্ধার সেবা করে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে!
সে তো আর একজন মানুষকেও দেখল না!
জীবন আরো অনেক লম্বা হলেও সম্ভবত দেখতে পাবে না
এই যে দরজাটা খোলা আছে, সারাজীবন সেটাকে এভাবেই খোলা রেখে কাটিয়ে দিতে কজন পেরেছেন পৃথিবীতে! ইতিহাসের বাইরে, কিংবদন্তির বাইরে নিজের জীবনকে একেবারে আলাদাভাবে গড়ে নিয়েছেন এক সাধারণ চাকুরে। খুব অল্প লোক সাক্ষী থাকবে তার। ইনি কবিতার জন্য নন। উপন্যাসের জন্যএকটা উপন্যাস এঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে অনিমিখের আছে। হয়তো সেটা সে লিখবে দাস্তাইয়েভস্কির লেখার আদলে। অনেকটাই আবেগ ঢালবে। মনস্তত্ত্ব ঢালবে। ভাবনাটা শুধু একবার আকার পেলেই হয়, লিখে ফেলবে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে প্রথমেই জ্যোতির্ময়ের ঘর।
ভেজানো দরজা।
ঠেলল।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাথর হয়ে গেল।
জ্যোতির্ময় শুয়ে আছেন বিছানায়। তাঁর মাথার একরাশ পাকা চুল বালিশ উজ্জ্বল করে আছে। পাশে রিয়ার উজ্জ্বল মুখ। কী যেন বলছে রিয়া তাঁর কানে ফিসফিস করে, আর খিলখিলিয়ে হাসছে। ওর একটা ঝলমলে হাত জ্যোতির্ময়ের চুলে খেলে বেড়াচ্ছে।
রিয়ার এত আলোভরা মুখ সে কয়েক বছর পর দেখল।
পরমুহূর্তেই সেই মুখ কালো হয়ে গেল অনিমিখকে দেখতে পেয়ে।
জ্যোতির্ময় মাথা তুলে তাকানোর আগেই অনিমিখ সরে গেল দরজা থেকেসিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামলপ্রায় ছুটতে ছুটতেই ফিরে এল নিজেদের বসার ঘরে
বসে পড়ল কাউচে                                                                 

সদর দরজার বাইরে, বাগানের নরম মাটিতে, রিয়ার দ্রুত পায়ের আওয়াজ নির্মিত হচ্ছে





-সমাপ্ত-