সকাল থেকে অন্বেষার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করল না অনিমিখ। শেষ রাতে তার একটু ঘুম এসেছিল, সকাল সাতটার আগেই সেটা ভেঙে গেল। আজ বাজার যাওয়ার ঝামেলা নেই। অনেকক্ষণ শুয়ে রইল চুপচাপ। মাথার পাশের জানালাটির কাচে জমে থাকা হিমের ফোঁটাগুলো দেখল। তাদের গড়িয়ে নামা দেখল। তারপর উঠে কম্পিউটারে বসল। কিছু লেখার চেষ্টা করল। অবিশ্যি দু-লাইনের বেশি এগোল না –
তোমার জন্মনক্ষত্র এবং আমার জন্মনক্ষত্রের মধ্যে
যে শালবন আদিগন্ত
তৃতীয় লাইনটা আর এল না। মাথা ঝাপসা হয়ে আছে। ওই দুটো লাইনও খুব বিশ্রী এবং সেন্টিমেন্টাল মনে হল তার। এইরকম লেখা পাঠালেই আজকাল
ছাপা হয়ে যায়। কিন্তু কতদিন আর এরকম বানানো লাইন লিখে যাবে সে ! কবিতা ছাপানো কি এতই জরুরি! এর চেয়ে তো কোনো ডেইলি সিরিয়ালে চাকরবাকরের রোল করা ভালো!
লাইন দুটো ডিলিট করে দিল অনিমিখ। তার মনে হচ্ছিল একটা কিছু আসতে চাইছে, সে টের পাচ্ছে, কিন্তু হদিশ পাচ্ছে না। এই অনুভূতি তার আগে কোনোদিন হয়নি।
রিয়া চুপচাপ কফি দিয়ে চলে গেল।
ওর মুখ মেঘলা হয়ে আছে। ও কি কিছু সন্দেহ করছে? রাতে সেটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। আরো বিগড়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে তার নিজের মনের
আবহাওয়া দুঃসহ হয়ে আছে, অন্যকে কী করে ভোলাবে
! বরং স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখা যাবে।
একটা কবিতার আভাস মাথার মধ্যে নিয়ে সে স্নান করল। ভাত খেল। স্কুলের উদ্দেশে বেরোল। অনিমিখ টের পাচ্ছিল তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তার মুখ দেখে যে কেউ বুঝে নেবে সে মানসিকভাবে ভালো নেই এই মুহূর্তে। স্টাফরুমে সকলে তার দিকে একটু আড়চোখে তাকালেন। অনিমিখ গায়ে মাখল না। আড়চোখ এই স্কুলেও তার অভ্যাস
হয়ে যাবে।
জগন্নাথবাবু ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র প্রথম পাতা দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট তো সমকামিতাকে বেআইনি করে দিল মশাই! আপনি লেখক মানুষ, কী বলেন, ঠিক হল এটা?’
তার লেখক পরিচয় তাহলে পৌঁছেই গেল এখানেও! অনিমিখ দেখল অনেকে তার দিকে না তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। সে একটু থমকে গেল। সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি আবার লেখক কবে হলাম? ওসব কিছু না। যাই হোক, যদি জিজ্ঞাসা করেন তো বলি, দুজন পুরুষ বা দুজন মেয়ে বন্ধ দরজার ওপারে নিজেদের ইচ্ছায় কী করছে, সেটা জানার প্রয়োজন সমাজ বা আদালতের খুব একটা হয়তো নেই, তাই না? কারো পাকা ধানে তো আর তারা মই দিচ্ছে না!’
গলায় অজান্তেই একটু ঝাঁঝ এসে পড়েছিল। সামলে নিয়ে একটু হেসে ক্লাসে চলে গেল তারপর।
প্রথম পিরিয়ডে অনিমিখের আবার একটু মাথা গরম হল। উপস্থিতি নেওয়ার সময় অষ্টম শ্রেণির একটি ছাত্রী নিজের ব্যাগ নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, ফলে প্রেজেন্ট দিতে ভুলে গেল। অনিমিখ পরে তার প্রেজেন্ট নিল, কিন্তু একটু কড়া কথা শুনিয়ে। এই স্কুলে সে অপ্রিয় কথা বাধ্য
না হলে বলবে না ঠিক করেছিল, সেটা আজ হল না। ব্ল্যাকবোর্ডে ভারতবর্ষের মানচিত্র যখন আঁকছে, পকেটে ফোনটি কেঁপে উঠল। তার বুকও। কিন্তু এখানে সে ফোন খুলে দেখতে
পারবে না। নিজের অস্থিরতাকে দমিয়ে রেখে অনিমিখ রুদ্ধশ্বাসে পড়িয়ে চলল। গলা কাঁপছিল, কিন্তু সেটা
হয়তো নিজেই একমাত্র লক্ষ্য করল।
পরের পিরিয়ডের ক্লাস ছিল নবম শ্রেণির ‘খ’ বিভাগে। কিন্তু একজন মাস্টারমশাই তার মধ্যে টয়লেটে তো একবার যেতেই পারেন। কোনো প্রতিষ্ঠান সেটা আটকাতে পারে না। সেখানে গিয়ে দেখতে পারে না তিনি ধূমপান করছেন, না ফোনে কথা বলছেন!
অন্বেষারই মেসেজ – sombhob hole
ektaa phone koro please. ekhuni.
অনিমিখ এক সেকেন্ডও দেরি না করে মেসেজ থেকেই নম্বরটা লাগাল। উলটো দিক থেকে ভেসে এল অন্বেষার উৎকন্ঠিত গলা, ‘হ্যালো।’
‘বলো।’ যতটা সম্ভব নিস্পৃহতা বজায়
রেখে বলল অনিমিখ।
‘এই, তুমি কি রাতে ট্রাই করেছিলে?’
‘বার পঞ্চাশ।’
‘একটা খারাপ খবর আছে। বেশি কথা বলতে পারবো না। ও এখুনি এসে পড়বে। ওষুধ কিনতে গেছে।’
‘কী?’
এই উদবেগের অভিনয় করতে হল না অনিমিখকে।
‘গতকাল সন্ধেবেলায় আমার একটা… মিসক্যারেজ হয়েছে। বাচ্চাটা আর নেই। সারাটা রাত এখানকার নার্সিংহোমে ছিলাম। এইমাত্র বাড়ি ফিরেছি।’
অনিমিখ স্তম্ভিত হয়ে গেল। এমন ভঙ্গিতে অন্বেষা গর্ভপাতের খবরটা দিচ্ছে যেন সেটা সাধারণ সর্দি-কাশির চেয়ে বেশি কিছু নয়! সামলে নিয়ে ফ্যাকাশে গলায় বলল,
‘তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে জানতাম না তো! স্কুলে
তো কেউই জানত না!’
‘কাউকে বলিনি। এর আগেও দু-বার এমন হয়েছে। শুধু শুধু লোক হাসিয়ে লাভ কী বলো? তোমাকে হয়তো গতকাল বলতাম…’
‘তুমি ঠিক আছো ?’
‘বেশ দুর্বল। অনেকটা ব্লিডিং হয়েছে। বিছানাটা পুরো নষ্ট করে ফেলেছি। এই শোনো, ও মনে হয় ফিরে আসছে!
আজ তোমার সঙ্গে কথা বলব। সন্ধের পরে ও বেরোলে আমি মিসড কল দেবো। তখন তুমি ফোন কোরো। ওকে?’
‘ওকে।’
ফোন কেটে গেল।
প্রথমে অনিমিখের নিজেকে হতবাক এবং বুদ্ধিহীন মনে হচ্ছিল। এটা সে বুঝতে পারেনি! অবিশ্যি বুঝবেই কী করে! অন্বেষার শরীরে কোনো পরিবর্তন
সে স্কুল ছেড়ে আসার দিনেও লক্ষ্য করেনি। আচরণও ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। শুধু সে নয়, মোরগমারির
কেউ বুঝতে পারেনি। অন্বেষাও তো সেই কথাই বলল, কাউকে সে জানতে দেয়নি নিজের অবস্থাটি।
তার মানে অনিমিখ একটি গর্ভবতী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে গত এক সপ্তাহ
ধরে ! ভাবা যায়!!
খুব হাসি পেল অনিমিখের। একটি শিশু এই পৃথিবীতে আসতে পারল না, দরজা থেকেই ফিরে যেতে হল তাকে, এই মর্মস্পর্শী চিন্তাও তাকে নিজের হাসি থামাতে দিল না। মাস্টারমশাইদের পেচ্ছাপের গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে দুলে দুলে হাসল
কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজের অসাড়তা লক্ষ্য করে লজ্জিত হতে পারল। ক্লাসে গেল।
অনিমিখ অন্বেষাকে জিতে নিতে পেরেছে তাতে আর সন্দেহ নেই।
কিন্তু সত্যিই কি তা সম্ভব ছিল!
একটি বিবাহিতা গর্ভবতী মেয়ে কী করে অন্য এক পুরুষের প্রেমে পড়ে! এ কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়! ওই
অবস্থায় কি কিছুই তার পাওয়ার বাকি থাকে একটি পরপুরুষের কাছে, এমনকি মানসিক ভাবেও!
মেয়েদের সে সত্যিই কিছু চেনেনি! এতটুকুও চেনেনি!
এক অদ্ভুত পরিস্থিতি এই মুহূর্তে অনিমিখ নিজের জন্য তৈরি করেছে। অন্বেষার সঙ্গে সম্পর্কে সে প্রতি পদক্ষেপে নিজের কল্পনাশক্তির দৌড়
পরীক্ষা করছে। সেই দৌড়ে সে নিজে হিস্যা নিয়েছে, হেরে যেতে তার ইচ্ছে নেই, জিতে গেলেও নিজেরই কল্পনার হার তার সহ্য হচ্ছে না।
অবিশ্যি কল্পনার কাছে না হারলে চরম নেশা হবে না। এই যে খুব ভাসমান মনে হচ্ছে তার নিজেকে স্কুলের বাকি সময়টা, একটা অন্য জগতে যেন চলে গেছে, সেখানে তার নিজের হাত নেই,
জাত নেই, গমন নেই, গত্যন্তর
নেই - এই তো নেশা! এই তো মোহগ্রস্ত হওয়ার মজা! এই তুরীয় অবস্থার স্বপ্নই কি বদল্যের দেখেননি ? উনি পাপের
নামে আসলে তো নেশাই চেয়েছিলেন, হাতে পেয়েও না ধরে রাখতে পেরে
সারা জীবন পুড়ে গেছেন, সেই দহনেই ফলিয়েছেন অপরূপ কবিতার ফসল,
হয়ে উঠেছেন কবিদের দেবতা। অনিমিখ হাতের মুঠোয় পেয়েছে সম্ভবত, কিন্তু আজ আর তার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে না। বরং সে আজ ভূগোল পড়াবে, কিন্তু একটা প্রেমের কবিতা লিখতে তার হাত সরবে না। এ এক অসহায়তা, যেন কেউ তাকে
মৈথুনে ব্যবহার করে নিচ্ছে, সে সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না,
কিন্তু অহং আহত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। মাতালরা হয়তো এই কারণেই মদ খেয়ে শোরগোল করে, হয়তো জানান দিতে চায় তারা নিজেদের ইচ্ছায় মাতাল
হয়েছে, এই অপ্রস্তুত অবস্থাটা তাদের নিজেদের নির্বাচন!
প্রেম সে বিয়ের আগে করেছে, একাধিকবার করেছে। শরীর বাদ দিয়ে করেনি। তেমন মেয়ে সে খুঁজে নিতে পেরেছিল। কিংবা সেই মেয়েরাই তাকে খুঁজে নিয়েছিল। পরে বিবাহিত জীবনেরও সুদসহ
আসল বুঝে নিয়েছে। রিয়া তাকে সবকিছুই তো দিয়েছে! একজন বারবণিতাও এতখানি দিতে চাইবে না হয়তো, রিয়া তাকে
যা দিয়েছে! বিছানায় অনিমিখ কখনো কবিতা ভাবেনি। বরং একের পর এক হার্ড কোর ব্লু-ফিল্মের সিডি চালিয়ে মেয়েটাকে সে নিজের বিচিত্র পথে নিয়ে এসেছে। বোঝাতে চেয়েছে প্রেমের আসল জায়গাটা মোটেই ঠোঁট নয় – বরং দেহের খুব নোংরা কিছু জায়গাতেই সেটা আছে। যে ব্যাপারগুলোকে রিয়া নোংরা ভাবত, বিয়ের পরে প্রথম দিকে করতে চাইত না, যন্ত্রনায় কাতরে উঠত, ঘেন্নায় শিউরে উঠত, আজ সেগুলো না পেলে রাতে নিজেই মেজাজ খারাপ করে। নিজের বৌকে এত যত্ন নিয়ে কেউ হয়তো পারভার্ট বানাতে চায়নি, অনিমিখের চেয়ে সফলভাবে পারেওনি! তাদের বিছানার অনেক দৃশ্য অনেক ‘সুস্থ’ দম্পতির বমির উদ্রেক করতে পারে।
কিন্তু তাহলেও রিয়া তার নিজের বৌ। রিয়া তাকে নতুন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আর রাখে না। হয়তো খোলা রাস্তায় সেক্স করতে পারলে, কানায় কানায় ভর্তি কোনো স্টেডিয়ামে ওকে করতে পারলে
পুরনো থ্রিল আবার জেগে উঠবে।
সেটা হওয়ার নয়।
এবং পরকীয়ার তো জাস্ট তুলনা নেই!তার স্বাদ অনির্বচনীয়। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রিয় লাইনগুলো এবার হয়তো অনিমিখ নিজের করে পাবে, এতদিন তো শুধু ব্যবহার করেছে লেখায় উজবুকের মতো,
অনধিকার চর্চায়।
আজ যদি অন্বেষার মেসেজটা না আসত, হয়তো সে জীবনের প্রথম কবিতাটা লিখতে পারত,
যেটা সকালে শুরু করতে গিয়েও পারেনি, সংকেতটা মাথায়
নিয়ে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, বয়ে এনেছিল স্কুল অবধি। সেটা হত তার নিজের কল্পনার কাছে হেরে যাওয়ার দলিল। ওই হার থেকেই একজন কবিতা লেখকের বদলে কবি হয়ে ওঠে। ঘুমিয়ে থাকা স্রোতটার স্বপ্নভঙ্গ হয়।
উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরল অনিমিখ। দরজা খোলা মাত্রই জড়িয়ে ধরল রিয়াকে। ঠোঁটে ডুবিয়ে দিল ঠোঁট কয়েক পলকের জন্য। হতচকিত অবস্থায় তাকে রেখে ঢুকল বসার ঘরে। সোনু কার্টুন দেখছিল, সোফায় বসে জড়িয়ে ধরল তাকে। মা-মেয়ে দুজনেই অবাক। বিয়ের পর এই প্রথম রিয়াকে বিছানার বাইরে চুমু খেয়েছে সে। এই প্রথম মেয়ের সঙ্গে কার্টুন দেখতে বসেছে।
একটু পরেই চা এবং পকোড়া নিয়ে এল রিয়া। মুখে একটা অন্যরকম আলো। এই আলো সেদিন দেখেছিল, যেদিন মোরগমারির স্কুল ছেড়ে এসেছিল, দরজা খুলে দিয়েছিল রিয়া।
‘কী ব্যাপার? এত খুশি!
কোনো প্রাইজ-টাইজ পেয়েছ নাকি?’
‘কেন?’ অনিমিখ হাসল,
‘আমি বুঝি খুব দুঃখে থাকি সবসময়?’
‘সেটা নয়। তবে তোমার খুশির হদিশ তো পাই না আমরা।’
রিয়া বেরিয়ে গেল, কিন্তু তার মুখের আলোটা আড়াল হল না, থেকে গেল ঘরের মধ্যে। সকালের মেঘ কেটে গেছে।
স্কুলের পোশাক বদলাল না অনিমিখ। অনেকক্ষণ মেয়ের সঙ্গে টিভি দেখল। হয়তো অনিমিখ সঙ্গে আছে বলেই রিয়া মেয়েকে পড়তে বসার জন্য তাড়াও দিল
না। বরং সে-ও এসে বসল টিভির
সামনে। অবিশ্যি বেশিক্ষণের জন্য নয়। এই ‘ডোরেমন’ বা ‘বেন-টেন’ জাতীয় কার্টুনগুলো রিয়া দু-চক্ষে দেখতে পারে না। অনিমিখ বেশ উপভোগ করে। অবিশ্যি এই অনুষ্ঠানগুলো যখন
চলে, তার মনে বারবার চলে যায় নিজের ছেলেবেলায়,
সেই যে দূরদর্শনে দেখানো হত ‘জনি সোকো এন্ড হিজ
ফ্লাইং রোবট’, বা ‘হি-ম্যান’, তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখত, পরের দিন স্কুলে তুমুল আলোচনা করত … কে জানে তার মেয়ে
সেগুলোর নামও কোনোদিন জানতে পারবে কিনা! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ওগুলো
দেখতে। ইউ-টিউবে রয়েছে, সে জানে। কিন্তু কম্পিউটারে যখন বসে, তখন আর ইচ্ছেটা থাকে না, মন
চলে যায় ফেসবুকে, বা মেলের ইনবক্সে।
মিসড কলটা এল সন্ধে সাতটা নাগাদ। অনিমিখ পোশাক বদলে ফোন নিয়ে ছাতে চলে গেল। আজ পূর্ণিমা। শীত হোক বা গ্রীষ্ম, এই রাতে কিছুটা সময় সে ছাতেই কাটায়। কেউ কিছু মনে করে না আর। নম্বর লাগিয়ে অন্বেষার গলা
শুনে তার প্রথম বাক্যটি হল একটি উৎকন্ঠিত ‘তুমি ঠিক আছো তো?’
অন্বেষা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘ঠিক আছি। তবে এখনও খুব দুর্বল। শুয়ে আছি বিছানায়।’
‘ও কোথায়? আজ তো ওর তোমার সঙ্গে
থাকা উচিত ছিল!’
‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গেই দেখা করতে গেছে। এসে পড়বে এখুনি। এই, তুমি কী করছ?’
‘তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল প্রচুর, তার মধ্যে আর কী
করব! যাক, তুমি ঠিক আছো জেনে একটু আশ্বস্ত লাগছে। আমি তো ভাবছিলাম তোমাকে একবার দেখতে চলে যাবো কিনা…’
‘ওটা ভুলেও কোরো না!’ অন্বেষা
ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ওকে তুমি চেনো না। সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
‘সেটা ভেবেই যাইনি শেষ অবধি। কিন্তু ছটফট করছি। তুমি বুঝতে পারবে না।’
‘বুঝতে পারছি। আমি বুঝি।’
কিছুক্ষণের নীরবতা। রোমাঞ্চ নেই তাতে। এই নীরবতা যেন টিভির বিজ্ঞাপন বিরতির মতো।
তারপর অন্বেষা বলল, ‘তুমি কেন এভাবে জড়িয়ে ফেলছ নিজেকে বলো তো? এর পরিণতি
জানো?’
‘কী আবার পরিণতি? কে জানছে আমাদের
সম্পর্কে?’
অন্বেষা চুপ করে গেল। এই কথার পর চুপ তো করতেই হয়। তারপর বলল, ‘আমি জানি
না। আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। অনেক সম্ভাবনা আছে তোমার মধ্যে। আমি হয়তো তোমাকে নষ্ট করে দেবো।’
এর উত্তরও প্রস্তুত ছিল অনিমিখের মুখে, ‘কিছু নষ্ট করবে না। বরং আমিই নষ্ট হতে বসেছি একঘেয়েমির চাপে। তুমি আমাকে বাঁচিয়ে তুলছ। আজ সারাদিনে অনেকগুলো কবিতা
লিখতে পেরেছি, জানো?’
‘তাই? কিন্তু আমি কবিতার কিছু
বুঝি না।’
‘কিন্তু এটা তো বোঝো, একজন জ্যান্ত
মানুষ সমাজের সবগুলো নিয়ম মেনে বাঁচতে পারে না? একটাই তো জীবন
অন্বেষা! কেন সেটাকে অন্যদের বানানো নিয়মের জন্য তুমি বলি দেবে? একটা বাঁধা সম্পর্কের বাইরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না? এভাবে পুতুল হয়ে
বাঁচবে? তোমার সুখী হতে ইচ্ছে করে না?’
অন্বেষা হেসে উঠল, ‘আমি খুব দুঃখী এমনই বুঝি তোমাদের ধারণা? এমনও তো হতে
পারে, ও আমাকে খুব সুখে রেখেছে?’
‘সেটার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়, আমি যতদূর শুনেছি। আমাকে তাহলে গিয়ে দেখে আসতে
হয় তুমি কতখানি সুখে আছ?’
এই ইশারাটা গলার ভঙ্গিতেই সম্ভবত খুব স্পষ্ট। অন্বেষা আবার চুপ করল। সময় নিল। আস্তে আস্তে বলল, ‘কোথা থেকে ফোন করছ? বাড়িতেই আছো?’
‘ছাতে আছি।’
‘লুকিয়ে ফোন করছ? হি হি হি
…’
‘সকলের সামনে করার তো প্রয়োজন নেই অন্বেষা!
তাতে কারো কোনো লাভ হবে কি?’
‘না। কিন্তু আর ঠান্ডা লাগিও না। নিচে নেমে যাও। ও আসছে, বাইকের আওয়াজ পেলাম। আমি এখন রাখছি। আর – আমি মিসড কল না দিলে কিন্তু আমাকে ফোন করবে না। আমি সুযোগ পেলে ফোন করে নেবো। টাটা। নেমে যাও।’
সেদিন খুব মাতিয়ে রাখল অনিমিখ সবাইকে। মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম সে এতখানি খেলল। মায়ের সঙ্গে গল্প করল।
এই প্রথম সে কোনোরকম আলো ছাড়াই রিয়াকে আদর করতে চাইল, মৃদু নাইট ল্যাম্পটিকেও নিভিয়ে। আদরে আদরে পাগল করে দিল বৌকে। চরম মুহূর্তের পরে দমবন্ধ কিন্তু অত্যন্ত খুশি গলায় রিয়া প্রশ্ন
করল, ‘আজ হঠাৎ এত পরিবর্তন তোমার? আমাকে তো কিছু করতেই দিলে না!’
অনিমিখও ইচ্ছে করেই একটু হাঁফাচ্ছিল। যেন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘অন্ধকারে তোমাকে আজ নতুন করে আবিষ্কার করলাম, করতে চাইলাম।’
‘তাহলে এবার থেকে আলো নিভিয়েই গবেষণাটায় নেমো। হি হি হি হি…’
রিয়া তার বুকে মুখ ঘসছিল।
ওর হাসি এতখানি মিলে গেল কী করে অন্বেষার সঙ্গে!
এর পরে দু-দিন অন্বেষার
কোনো সাড়াশব্দ নেই। অনিমিখ অস্থির হয়ে উঠল। একবার একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করবার চিন্তা করেও পিছিয়ে গেল। অন্বেষাই বারণ করেছে, ওটা ঠিক হবে না।
তৃতীয় দিন সকালে হিমভেজা জানালার পাশে মোবাইলে আলো জ্বলল।
অন্বেষার মেসেজ এসেছে – aaj o
saaraadin baari thaakbe naa. tumi chaaile aaste paaro.
ঘষাকাচের জানলাটা বন্ধ হলেও বোঝা যাচ্ছিল বাইরে ঘন কুয়াশা।
রোদ্দুর জমিয়ে লড়াইটা করছে।