৭ম অধ্যায়



স্কুলে সমস্যা হচ্ছে না তোমার? এই যে ঘন ঘন তোমাকে ডেকে নিচ্ছি, নতুন স্কুল, কেউ কিছু মনে করছে না?’
যদি করে কী করব?’ অনিমিখ হাসল, ‘আসব না তুমি ডাকলেও? স্কুলে ভূগোল পড়াব? আর আয়ান তোমাকে আদর করবে আমার হয়ে?’
অন্বেষা চোখ ফিরিয়ে নিল আস্তে আস্তে বলল, ‘তোমাকে আমি নষ্ট করে দিচ্ছি নিজেকে যেমন নষ্ট করেছি, তোমাকেও করে দিচ্ছি আজ কিছু বলছ না, কিন্তু একদিন তুমি দোষারোপ করবে আমি জানি করবেআর তোমার বৌ যদি কোনোদিন জানতে পারেইশ! আমাকে সেদিন গলায় দড়ি দিতে হবে!
তাই? কী করবে তাহলে এখন? সবকিছু ডিলিট করে নতুন করে কম্পোজ করবে আবার? তারপরেও যদি প্রুফ দেখতে ভুল হয়ে যায়?’
মজা কোরো না সত্যি করে বলো তো, তোমার মনে হয় না আমি একটা খুব বাজে মেয়ে?’
আমিও একটা খুব বাজে লোক
তার মানে তুমি মেনে নিলে আমি একটা বাজে মেয়ে!
তোমার স্কুলের খবর কী? মানে, আমার পুরনো স্কুলের? এই যে তুমি রোজ রোজ ডুব দিচ্ছ আমার জন্য, সেখানে কী চলছে? সবাই বুঝি খুব খুশি তোমার উপর?’
আমি তো বলেছি আমি একটা বাজে মেয়ে! একটা অপদার্থ টিচার! বলেছি তো আমি! আর, তুমি আমার বরকে আয়ান বলবে না একদম না

আশ্চর্য একটা জায়গায় তারা এসেছে। সেই লজের দিনটির পরে একমাস কেটে গেছে এর মধ্যে তারা আরো বার পাঁচেক শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছেপ্রতিবারেই অন্বেষার বাড়িতে এখন অন্বেষার সাহস অনেক বেড়ে গেছে অয়ন কোনো কাজে একটু গেলেই অনিমিখকে ফোন করে বাড়িতে ডেকে নেয় অনিমিখও বাইক নিয়ে চলে আসে স্কুলে কোনো অছিলা না দেখাতে পারলে কিছু না বলেই বেরিয়ে চলে আসে পরের দিন ঝামেলা হয় নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে এখন তার সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে তবে রিয়ার সঙ্গে অভিনয়টা এখন সে রপ্ত করে নিয়েছে শারীরিকভাবেও ফাঁকি দিতে পারে, শুধু ঘরের আলো জ্বালা চলে না কল্পনাশক্তির সঙ্গে এখন তার ওইটুকু সময়ই দেখা হয়
কবিতা লেখা বন্ধই আছে লেখার কথা ভাবলে গায়ে জ্বর আসে হয়তো এই বিরতির পরে সে সত্যিই কিছু লিখতে পারবে এই তার আশা
আজ অয়ন কলকাতা গেছে কিন্তু আজ অন্বেষা বিছানায় যেতে চায়নিমেরুণ শাড়ি পরে অনিমিখের বাইকে চড়ে বেড়াতে আসতে চেয়েছে আসলে ওর আজ শরীর ভালো নেই কয়েকদিন আগে জ্বর বাঁধিয়েছিল দুর্বলতা কাটেনি এখনও কিছু খেতে পারছে নামুখে কোনো স্বাদ নেইস্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে।
তাই এই জায়গাটিতে তারা বেড়াতে এসেছে। শুধুই বেড়াতে। উগ্র লাল মাটিতে তৈরি এক ভূমিরূপ। রোদ্দুরে সেই লাল চোখ ঝলসে দিচ্ছে ল্যাটেরাইট পাথরের সঙ্গে হাওয়ার খেলায় তৈরি হয়েছে বিরাট বিরাট খাদগুলো তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে বর্ষাকালে শিলাবতী নদীর খামখেয়ালি চলন কথিত আছে মহাভারতের সময়ে ভীম আর বকরাক্ষসের যুদ্ধ নাকি এখানেই হয়েছিল সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নাকি ধারণ করেছে এই অদ্ভুত ভূমিরূপ অনিমিখ এই জায়গার নাম জানলেও আসেনি কখনও, এইসব গল্পও জানত না অন্বেষাই এগুলো বলেছে শুনলেই রোমাঞ্চ হয়! বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন তারপরেঅবিশ্বাস করতে ইচ্ছেও করে না
পায়ের তলায় শক্ত লাল কাঁকুরে মাটি মাথার উপর আশ্চর্য নীল আকাশে রোদ জ্বলে আছে অনিমিখ কারণ ছাড়াই বলে উঠল, ‘দুঃখী রাজহাঁস, জল পেলে নেমে যাবো, সন্তরণ এত সোজা নয়
অন্বেষা খুশি হয়ে তাকাল, ‘কবিতার লাইন পেলে?’
তার সঙ্গে সম্পর্কের পরে অনিমিখ কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে, এটা অন্বেষা জানে, এবং এটা তার কাছে খুবই বিরক্তির বিষয়
অনিমিখ হাসল, ‘দূর! এটা প্রভাত চৌধুরীর লেখা কবিতার লাইন আমার নয়উনি অবিশ্যি দুঃখ নিয়ে লিখেছিলেনআমার দুঃখ-টুঃখ নেই। তবু আকাশটা দ্যাখোএই লাইনটাই মনে পড়ে গেল এখানে এসে
অন্বেষা মুখ ফিরিয়ে নিল আস্তে আস্তে বলল, ‘এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে এলাম, কোথায় নিজে একটা কবিতা লিখবে, তা না, অন্যের লাইন শোনাচ্ছে আমাকে!’
অনিমিখ হাসি থামায়নি হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমার বৌয়ের দুঃখটা আবার আরো গভীর, জানো তো? আমি ওকে নিয়ে একটাও কবিতা লিখিনি
দুঃখ তো করবেই বেচারি! বর যদি না লেখে, ওকে নিয়ে কবিতা লিখবে কে শুনি? রবি ঠাকুর?’
রবি ঠাকুর অন্যের বৌকে নিয়ে কবিতা লেখেননি, তোমাকে কে বলল?’
লিখতে পারেন মানুষ হোক, দেবতা হোক, কবিরা তো অমনই হয় তোমাকে দেখেই বোঝা যায়
তাই? অথচ তোমাকে নিয়ে একটাও লিখলাম না!’
সেটাই তো দুঃখ! সেই দুঃখেই মরে যাচ্ছি আমিও
অন্বেষা আজকের দিনটা পুরোপুরি উপভোগ করতে চাইছেএকথালা সুগন্ধি ভাতের মতো মেখে খেয়ে নিতে চাইছে এক কিশোরীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এই প্রথম সে গান গেয়ে উঠল অয়নের সামনে -  এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণগেয়েই থেমে গেল হাসল অনিমিখের দিকে তাকিয়ে, ‘কী বোকা বোকা না? জীবনটাকে যেন সিনেমা মনে হচ্ছে!’
অনিমিখও হাসল, ‘ঋতুপর্ণ ঘোষের কোনো সিনেমা কি? বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে…’
উঁহু একদম উত্তম-সুচিত্রার
যেন কোনো কারণ ছাড়াই এই মধুর মুহূর্তে অনিমিখের চোখের সামনে ভেসে উঠল মিলন সামন্তর মুখ তার প্রাক্তন সহকর্মী বন্ধুটি সেই দিনের পর তাকে ফোন করেনি, সে-ও করেনি যদি মিলন জানত সে এখন অন্বেষার সঙ্গে এখানে নির্জনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেমন হত তার মুখ? অনিমিখের হাসি পেল
এখানে প্রচুর কাজুবাদাম গাছ আছে কাজুবাদামের চাষ হয় এখানে অন্বেষা গাছগুলোর ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বোঝাই যায়, ও এর আগেও এসেছে এখানে অয়নের সঙ্গে কি? সেটাই হবে খড়্গপুরের মেয়ে অন্বেষা এই জায়গাটা সম্পর্কে এতকিছু জানল কী করে? এই সুন্দর ভূমিরূপটির মধ্যেপাপশব্দটাকে অনেক দূরের মনে হয়, আরো বেশি লোভনীয়।
এখানে নাকি কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে! প্রেমিকের আত্মহত্যা প্রেমিক-প্রেমিকার যুগলে মৃত্যু খাদগুলিতে ঝাঁপ দিলে মৃত্যু অবিশ্যি অনিবার্য এখন সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে লাফিয়ে যদি পড়ে? ওই যে বিরাট পাথরটা, ওটাতেই কি তার মাথাটা চৌচির হয়ে যাবে? যখন নীচে গিয়ে পড়বে, হয়তো দু-এক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না ওখানে গিয়ে পড়তে, তখন আর তার দেহে প্রাণ নেই দেহে প্রাণ নেই, নাকি শরীরে নেই? তার নিজের শরীর অন্বেষার হাতের বেষ্টনীতে কেমন দেহ হয়ে যায়! রিয়ার পাশে শুলেই শরীর থেকে দেহ বেরিয়ে আসতে চাইত তার কয়েকমাস আগেও
আচ্ছা, মৃত্যুর পরে আরশরীরশব্দটা কি কোনো কাজে লাগে না? কেউ তো বলে নামৃত শরীর’, সবাই বলেমৃতদেহ’, বানশ্বর দেহ’ !
দেহ আর শরীরের পার্থক্যটা কোথায়? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান একবার দেখতে হবে বাড়ি ফিরে। এ নিয়ে কি একটা কবিতা লেখা চলে! এই ২০১৪-এ সেটা কি খুব সেকেলে মনে হবে! লেখা চলে হয়তো, বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লেখা তো কঠিন কাজ নয়। নিজের কবিতায় পৌঁছনো অবিশ্যি দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্গম ব্যাপার।
পিছন থেকে অন্বেষার হাসিমাখা গলা ভেসে এল, ‘অত অন্যমনা হোয়ো না! পড়ে যাবে আর একটু দেখেশুনে চলো! এখানে কিন্তু প্রচুর চন্দ্রবোড়া সাপ আছে! এই জায়গাটা সাপ আর কাজুবাদামের জন্যই বিখ্যাত
সাপ কবিকে কামড়ায় না চুমু দেয় তাতে কবি মরে না
কিন্তু তুমিই তো বলছ তুমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছ! সাপের কানে সেই খবর পৌঁছে যেতেও তো পারে!’
আমি অত বিখ্যাত ছিলাম না অন্বেষা! আর শুনেছি সাপের কান থাকে না সাপ শরীর দিয়ে শোনে
বাজে বোকো না এদিকে এসো
অনিমিখ কাছে যেতেই অন্বেষা তাকে টেনে নিয়ে জোরে চুমু খেল, দ্রুত আদর করল, বলল, ‘ওসব কথা একদম মুখে আনবে না তুমি তোমাকে অনেকের প্রয়োজন আছে জেনো
তোমার?’
শুধু আমার কেন! আমি মোটেই অত জরুরি নই তোমার বৌ আছে, মেয়ে আছে, লেখালেখি আছে আমি কি তোমাকে একেবারে নষ্ট করে দিলাম?’
কেউ কাউকে নষ্ট করতে পারে কি, যদি সে নিজে না হতে চায়?’
জানি না নিজেকে খুব দোষী মনে হয়, জানো! রিয়ার সামনে আমি কোনো দিন দাঁড়াতে পারব না ওই একটা মানুষের চোখকে আমি সারাজীবন ভয় পাবো হয়তো
এই তো তুমিই বললে আমরা পান্ডবদের বিচরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি! তোমার মনে হয় না সেই পৌরাণিক দিনগুলোই মানুষের স্বভাবের পক্ষে ঢের ঠিক ছিল? তখন একটি পুরুষের একের বেশি নারী, একটি মেয়ের একের বেশি পুরুষ স্বাভাবিক ছিল, খুব বেশি হলে একটু দৈব কাহিনির অবতারণা করতে হত পেটে বাচ্চা এসে গেলে অবিশ্যি কোনো ঋষি বা দেবতা-টেবতার গল্প শুনিয়ে দিতে হত। আর আমরা, এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে এসব ভেবে কুঁকড়ে যাচ্ছি নিজেদের মনে মনে রোজ জেলে পাঠাচ্ছি, ফাঁসিকাঠে চড়াচ্ছি! মনে হয় না তোমার, দ্রৌপদী বা ভীমসেন তাঁদের বিবাহিত জীবনে একজন আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক সৎ ছিলেন?’
অন্বেষা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘জানি না তবে দ্রৌপদী আসলে নাকি কর্ণকে ভালোবাসতেন! ভাবা যায়, পাঁচ-পাঁচজন স্বামী তাঁর, একেকজন দিকপাল, তবু…’
মহাভারতের কবি আমাদের উপন্যাসকারদের চেয়ে মানুষের সাইকোলজি ঢের ভালো বুঝতেন অন্বেষা চিরদিনের সাইকোলজি।
হয়তো কিন্তু পরশুরাম আর তাঁর বাবা-মায়ের গল্পটাও তো আছে! মহাভারত ছাড়াও রামায়ণ আছে আমাদের দেশে রামায়ণকে কিন্তু মহাভারতের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবেসেছে মানুষ! বিশ্বাস করেছে! উত্তর ভারতের অনেক বাড়িতে মহাভারত রাখে না, ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া হবে এই ভয়ে! সেটা জানো? আমি খবরের কাগজে পড়েছিলাম।
একটা কথা বলি?’
বলো
মহাকাব্য ছেড়ে একটু আমার দিকে তাকাও প্লিজ! ওই ঝোপটার আড়ালে কেউ দেখতে পাবে না চলোমরে যাচ্ছি!’
ছন্দের কোনো তোয়াক্কা না করেই অনিমিখের ওই কথার পরেও রোদ একইরকম উজ্জ্বল হয়ে রইল গাছের পাতা তার উষ্ণতা নিয়ে খেলা করতে থাকল কনকনে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে অনেক দূরে লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজ হয়তো একটা দল পিকনিক করতে এসেছেহয়তো একটা পরিবার এসেছেআজ সারাদিন ওরা এখানে আনন্দ করবেখাওয়া-দাওয়া করবেবাসন-কোসনের শব্দের মধ্যে বাচ্চাগুলো দৌড়ে বেড়াবেসকলে এসেছে আরেকটু বাঁচার রসদের জন্যওদের কেউ যদি এখানে চলে আসে এখন? এই জৈব দৃশ্য সেই মানুষটার জীবন কি বদলে দেবে? এই জায়গাটার ফুর্তির ইতিহাসও কি বদলে যাবে তারপর?
অনিমিখ তার বন্ধ চোখের ওদিকে রোদ্দুরের লাল আভা টের পাচ্ছিল চোখের পাতায় রক্তের লাল মিশেছে যখন চোখ একেকবার খুলছিল, দেখতে পাচ্ছিল দূরে লাল মাটি আর সবুজ গাছপালার মধ্যে দৌড়ে চলেছে তার পাপের ধারণা পাপ যেন তাকে ফুসলানি দিচ্ছে আরো একটু দ্রুত দৌড়নোর জন্য, চাইছে রেসটা আরো জমে উঠুক কিন্তু সে তাল মেলাতে পারছে না পিছিয়ে পড়ছেপিছিয়ে পড়ছে
কল্পনা তো নেই! দূর দিগন্তেও নেই!
কল্পনা কি চিরবিদায় নিয়েছে? 
চন্দ্রবোড়া সাপগুলো ঘুমোচ্ছে শীতঘুম
‘আহ্হহহহহহহ্!!!’
অন্বেষা বিকৃত মুখ তুলল। ঠোঁট এবং থুৎনিতে হাতের উল্টোপিঠ ঘসল। মলিন হেসে বলল, ‘এই সুন্দর জায়গাটাকে নোংরা করে দিলে তুমি!
দম ফেরাতে ফেরাতে অনিমিখ উত্তর দিল, দূর! আরো সুন্দর হয়ে উঠল তুমি তাকাতে জানো না
স্বার্থপর!

জায়গাটা থেকে ফেরার পথেনোংরাএবংস্বার্থপরশব্দদুটো বাইকের শব্দ ছাপিয়ে তার কানে বাজছিল শেষ পর্যন্ত ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘তুমি নোংরা বললে আমাকে? স্বার্থপর বললে?’
অন্বেষা অনিমিখের কাঁধে একটু দাঁত বসাল হেসে বলল, ‘এত সিরিয়াসলি নিলে তো মুশকিল! আজ তোমাকে যেটা দিলাম, অয়নকেও দিইনি ও চেয়েও পায়নি, সেটা জানো? তুমি প্রায় না চেয়েই পেলে।
কিন্তু তুমি ওটা বললে কেন? বলতে পারলে?’
সরি! কান ধরবো? মানে, তোমার কান?’
ঠাট্টার মধ্যে অনেক সময়েই আমি লোকের মনের কথার হদিশ পাই
অন্বেষা আর কোনো উত্তর দিল না বাইক ছুটে চলল পোড়া কোল্ড স্টোরের উদ্দেশে অনিমিখের এবার একটু খারাপ লাগছিল যদি কথাগুলো অন্বেষা মন থেকেই বলে থাকে, ওকে কি দোষ দেওয়া চলে? বরং সাবাশি দেওয়া উচিত যে কথাগুলো অনিমিখ নিজেকে বলতে ভয় পায়, ও সেগুলোই অনায়াসে উচ্চারণ করেছে মেয়েটা তো এমনই! কোনোকিছুর পরোয়া করে না! কোনোকিছুর ধার ধারে না যেটা চায় করে যেটা চায় বলে
এক জায়গায় দেখল পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে হেলমেটবিহীন একজন বাইক আরোহীকে ধরা হয়েছে হাসিমুখেই কথাবার্তা চলছে
অনিমিখ হেসে বলল, ‘দেখেছ? সব পুলিশ যেমনজঞ্জীর’-এর অমিতাভ বচ্চন হয় না, সব মাস্টারও শিক্ষক হতে পারে না তাই না?’
অন্বেষা বলল, ‘আমার কিন্তু শিক্ষকতার পেশাটাকে কলুষিত করে কোনো আনন্দ হয় না!’
কলুষিত!’
তাই তো বলবে সকলে, যদি জানতে পারে!’
অনিমিখ সজোরে হেসে উঠল, ‘মোরগমারির মাস্টারনি আজ পরপুরুষকে মুখে নিয়ে শিক্ষকতাকে চিরকালের মতো কলুষিত করে দিয়েছে, তাই তো? এরপর আর কেউ মাস্টারি করতে চাইবে না, কেউ আর স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসবেই না হয়তো! তবু ভালো, তুমি সমকামী হয়ে যাওনি তাহলে তো আর…’
বাকি রাস্তায় দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হল না
পোড়া কোল্ড স্টোরের সামনে বাইক থামতেই অন্বেষা সোজা হেঁটে চলে গেল এক মুহূর্তের জন্যেও পিছু ফিরে তাকাল না হঠাৎ অনিমিখের মনে হল অন্বেষার হাঁটার মধ্যে জেদের পাশাপাশি যেন এক হতদরিদ্র চোরের আদলও ধরা পড়ে যেন এক ক্ষুধার্ত বিড়াল দক্ষ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রান্নাঘরের জানালা থেকে বেরিয়ে খুব সতর্কভাবে, মুখের মাছটি নিয়ে যে কোনো মুহূর্তে লোকে তাড়া করতে পারে ঢিল মারতে পারে মেরে ফেলতে পারে
হয়তো মাছের টুকরোটাতে বিষ মাখানো আছে!
খুব করুণ! খুব দুঃস্থ!
অনিমিখের বুকে রক্তপাতের মতো অনুভূতি হল সে তাড়াতাড়ি বাইক ঘুরিয়ে নিল

বাড়ি ফিরে অনিমিখ স্বামীর কর্তব্য করল রিয়াকে বিউটি পার্লারে নিয়ে গেল সঙ্গে সোনুও গেল রিয়া পার্লারে ঢুকে গেল অনিমিখ তখন মেয়েকে নিয়ে হেঁটে বেড়াল শহরের ঠান্ডা গলিগুলোয়
এই সময় কেউ বেরোয় না এখানেঅনেকেই লেপের তলায় ঘুমোচ্ছেআর কয়েক ঘন্টা পরে, বিকেল হলে বেরোবেআবার দোকানে যাবেমেয়েরা আড্ডা দিতে বসবে দল বেঁধেবাচ্চারা খেলতে শুরু করবেএই মফসসল শহরটির স্থায়ী বাসিন্দারা জীবনকে এরকমই মৃদু গতিতে চালিয়ে নিয়ে চলেছেগিয়ার বাড়াতে বললেও তারা রাজি হবে না, পেরে উঠবে নাএই শহরে পৈতৃক একটি ছোট দোকানের মালিককে অনেক টাকা দিয়ে দিলেও সে বড়ো ব্যবসার দিকে যেতে চাইবে নাওই টাকা সে রেখে দেবে তার ছেলের জন্য, মেয়ের জন্য, সভয়েহয়তো বাড়ি্র মেঝেতে পাথর বসাবে।
হাতে মেয়ের ছোট্ট নরম হাত মেয়েটা খুব শান্ত হয়েছে তার খুব লক্ষ্মী তার মতো বাবার হাতে ও কষ্ট পাবে না তো ভবিষ্যতে! একটা দুর্বল বাবা পেয়ে ওর জীবনে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে না তো! অনেক বছর পরে কোনো একদিন এই মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত চাইবে কি? সে কি মেয়ের চোখ চোখ রাখতে পারবে না সেদিন? কিংবা, একদিন এই মেয়েকে হয়তো সে সব খুলে বলবে!
তার আকাঙ্ক্ষার গল্প তার পাপের কাহিনি
আবার পাপ!!! পাপ শব্দটা এত সহজে এসে পড়ে কেন তার মনের জিভে!
জ্যোতির্ময়বাবুর মতো মানুষ আবার ব্যভিচার স্বীকার করেন না, ব্যতিক্রম বলেন আজ থেকে আরো এক দশক পরে সারা পৃথিবীর মানুষ কি মানুষেরঅন্যসম্পর্কগুলোকে ওই নামেই ডাকবে? সোনুও কি তা মেনে নেবে না!
অন্বেষার সঙ্গে আজ বেড়ানোটা তেতোভাবে শেষ হয়েছে মন খচখচ করছে ওই কথাগুলো কি না বললেই চলত না তার! খুব কি কর্কশ ছিল না তার শেষের কথাগুলো!
অনিমিখ মোবাইল বের করল বাঁ হাতে মেয়ের হাত রেখে ডান হাতে মেসেজ করল – miss korchhi tomaake khub. aagaamikaal school jaaoaar poth-e tule nebo tomaake? school jeo naa aagaamikaal.
দু-মিনিটের মধ্যে উত্তর এল – k aapni?
হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠল অনিমিখের এর মানে কী? কার হাতে পড়েছে তার মেসেজ? অয়ন? তাহলে সব শেষ!
অনিমিখের মুখ থেকে একটা আওয়াজ বেরোল
সোনু মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েচে বাবি?’
সে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বুক কাঁপছিল কাঁপা কাঁপা গলাতেই বলল, ‘কিছু না মা একটা পোকা
ফোন স্যুইচড অফ করে দিল অনিমিখ  হাতও কাঁপছিল খুব