১০ম অধ্যায়



সত্যিই দুর্দান্ত জায়গা এই বিষ্ণুপুর! তার শহর থেকে এত কাছে এই জায়গাটি, তবু সে নাম শুনেছে, কিন্তু এতদিন আসেনি, এটা ভাবতেই অবাক লাগছিল অনিমিখের। একেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু! এই প্রাচীন শহরের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ালে কখনও সখনও মনে হয় টাইম মেশিনে চেপে কয়েক শতাব্দী পিছনে চলে গেছে সে! যেন ঘোড়ার আওয়াজ পাচ্ছে, কামানের গর্জন ভেসে আসছে! কত কিংবদন্তি যে ভেসে আছে এখানে হাওয়ায় হাওয়ায়!
আবার এমনিতে তাকিয়ে দেখলে একটা সাধারণ ছোট শহর ছাড়া কিছুই নয়।
যে হোটেলে উঠেছে, সেখানে সে ঘর পেয়েছে দোতলায়। জানালা থেকে বিখ্যাত রাসমঞ্চের কিছুটা অংশ দেখা যায়। রোদে উজ্জ্বল রাসমঞ্চের দিকে তাকিয়ে সে চোখ ফেরাতে পারেনি। চলে গিয়েছিল কয়েকশ’ বছর পিছনে। আনুমানিক ১৬০০ খৃস্টাব্দে সেটা নির্মাণ করা হয়েছিল। একটা চটি বই সে কিনে নিয়েছে, সেখানেই এইসব তথ্য রয়েছে। বাড়ি ফিরে গুগল সার্চ করতে হবে, ঠিক করেছে। বিস্ময় জাগে ইমারতটার দিকে তাকালে। ঠিক যেন এক পোড়ামাটির পিরামিড! বেদিটা তৈরি হয়েছে মাকড়া পাথরে। উপরের অংশ ইট দিয়ে তৈরি। আগে টেরাকোটার কাজ ছিল, অল্প কিছু বাদে সব চুরি হয়ে গেছে। হয়তো সুন্দর রং-ও ছিল, তার আভাস আজও দেখা যায়। ১৯৩২ সাল অবধি এখানে রাস উৎসব হয়েছে। এখন শুধুমাত্র এক সংরক্ষিত ইমারত ভিতরের গলিগুলোতে লুকোচুরি খেলার সুযোগ রয়েছে। অবিশ্যি এখন আর তা সম্ভব নয়। এখন টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, এবং কড়া নজরদারি রয়েছে।
বিষ্ণুপুরের প্রায় সব স্থাপত্যই এখন পুরাতত্ত্ব বিভাগের জিম্মায়।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতেই সকাল গড়িয়ে যায়। স্নান-খাওয়া সেরে দুপুরের বেশির ভাগ সময় সে কাটিয়ে দেয় রাসমঞ্চের আশেপাশেইএই সময়টাই যেন এই ইমারতের জন্য আদর্শ! ভরপুর দিনের আলোয় এর বিরাট চেহারাটা খোলে ভালো।
সন্ধেবেলায় অন্যান্য মন্দিরগুলো আরো অপূর্ব হয়ে ওঠে। সময়ের ছাপ আরো স্পষ্ট হয় তাদের গায়ে।
এখন বেশ কিছু নাম তার মুখস্থ হয়ে গেছে – বীর হাম্বীর, রঘুনাথ সিংহ, বীর সিংহ, দুর্জন সিংহ, গোপাল সিংহ, চৈতন্য সিংহ। এঁরাই মল্ল রাজা। মল্ল মানে যোদ্ধা হয়, আবার অনেকে মাল উপজাতির সঙ্গেও এঁদের যুক্ত করেন। বাগদি সম্প্রদায়ের সঙ্গেও এই রাজাদের যোগ থাকা সম্ভব। অবিশ্যি এঁরা নিজেদের ক্ষত্রিয় দাবি করেছেন। মুসলমান শাসনকালেও এই মল্ল রাজারা রাজত্ব চালিয়ে গেছেন। বড়োজোর রাজস্ব দিয়েছেন। কিন্তু বর্ধমানের রাজার সঙ্গে শত্রুতা এবং বর্গিহানায় এঁরা শক্তিহীন হয়ে যান।
শহরে ঢোকার মুখে পাথরের দুটো  বিরাট তোরণ আছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অনিমিখ যেন বর্গিদের ঘোড়া ছুটে আসতে দেখল এক পলকের জন্য। তারপরেই নাকে এল মানুষের পায়খানার ঝাঁঝালো গন্ধ।

প্রতি মুহূর্তে অনিমিখের বুকের মধ্যে সব হারানোর ভয় এবং এই আশ্চর্য শহরটাতে প্রথম এসে একা একা ঘুরে বেড়ানোর মজা একইসঙ্গে খেলা করছিল। এর মধ্যে অবিশ্যি প্রতিদিনই অন্বেষার থেকে একটি করে মেসেজ সে রাতে পেয়েছে। সারাদিন সেই মেসেজের জন্য ভয়ে ভয়ে থেকেছে। জানতে পেরেছে অয়ন ডায়েরি করতে পারেনি শেষ অবধি। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেও কয়েক দিন বাইরে থাকার পরামর্শই অন্বেষা দিয়েছে তাকে, অয়নের গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে যেন সে ফেরে। আসলে পুলিশের পাশাপাশি অয়নের রিভলভারের ভয়টা কিছু কম নয়। অনিমিখ বুঝতে পেরেছে অন্বেষা তার বরের হিংস্রতাকে বিশ্বাস করে না।
আপাতত একজন অলস পর্যটকের মতো সে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিষ্ণুপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায়। বাড়িতে ফোন করে রিয়ার শুকনো জবাব পেয়েছে। রিয়ার রাগ পড়তে সময় নেবে। রাগ জন্মেছে অনেক সময় নিয়ে, কয়েকটা বছর নিয়ে, এত সহজে যাবে না।
অন্বেষাকে জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারলে তবেই অনিমিখ রিয়ার সামনে সহজ হতে পারবে। সেটা যতক্ষণ না হতে পারছে, কোনো মিষ্টি কথা কাজ করবে না। হ্যাঁ। অন্বেষাকে মুছেই ফেলতে হবে। দোষ-গুণের পরোয়া না করে ওকে ডিলিট করে দিতে হবে, এমনকি রি-সাইকেল বিন থেকেও।
অনিমিখ ঠিক করেছে সে এবার একজন ঠিকঠাক বর হয়ে উঠবে, একজন ভালো বাবা। একমাত্র এই দুটো পরিচয়ই সে কিছুটা হলেও ভেজালের বাইরে পেতে পারে। এখনও সেই সুযোগ আছে। জীবনটা তো আর মেকি কবিতা নয়।


এই মনোভাব তার মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠল সেদিন।


সেদিন দুপুরে সে দলমাদল কামানের কাছে গিয়েছিল। এই কামান নিয়ে অদ্ভুত কাহিনি প্রচলিত। মল্ল রাজাদের পারিবারিক বিগ্রহ মদনমোহন নাকি নিজে এই কামান দেগেছিলেন বর্গি হানার সময়ে, বাঁচিয়েছিলেন বিষ্ণুপুর শহরকে বর্গিদের হাত থেকে।
এসব কাহিনি শুনলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছে খারাপ কিছু নয়, ওই ইচ্ছেটাকেই কোলরিজ বলেছিলেন উইলিং সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ। ওটা থেকেই কবিতা জন্মায়, উপন্যাস জন্মায়। দলমাদল কামানের বিরাট নলটিতে নাক ঠেকিয়ে বারুদের মৃদু গন্ধ পেয়েছে অনিমিখ। সেটা তার হারিয়ে ফেলা কল্পনাশক্তির এক চিলতে হাসি হতে পারে, আবার হতে পারে স্থানীয় কিছু ছেলেপুলে ওখানে চকলেট বম ফাটিয়েছে!
গন্ধটাকে সে বিশ্বাস করেছে।
এরকম কোনো বিশ্বাসই কি তাকে বুকে জাগিয়ে তুলতে হয়নি অন্বেষার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে? এমনকি কোনো কবিতা লেখার আগে?
দলমাদল থেকে একটু হাঁটলেই ছিন্নমস্তার মন্দির। শোনা যায় খুব জাগ্রত।
মন্দিরে ঢুকে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল অনিমিখের মধ্যে। কথা নেই বার্তা নেই কী যেন হয়ে গেল তার, সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ঘন নীল বিরাট নারীমূর্তিটির দিকে। নিজের মাথা নিজে কেটেছেন এই দেবী, গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ওঠা তীব্র সরু রক্তধারা পান করছে তাঁর ছিন্ন মুন্ড, যেটি প্রসন্ন বদনে তাঁর হাতেই ধরা আছে!
এ কি মূর্তি!
এ কি কল্পনা!
এ কি এই পৃথিবীতে পরমা প্রকৃতির চরমতম রূপ!
অনিমিখ আজন্ম নাস্তিক। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও তার পৈতে দিতে পারেনি। অবিশ্যি ছিন্নমস্তা দেবীর নাম সে অনেক শুনেছে। দেখেছে ছবিতে। এই প্রথম তাঁকে নিয়ে ভাবল। তাঁকে দেখল একটি মেয়ে হিসেবে একজন মেয়েই তো উনি! হয়তো একজন মেয়ের ক্ষেত্রেই এই মূর্তির কল্পনা করা যেত, কোনো দেবতার বুকে এমন তেষ্টা সম্ভবত জাগতে পারে না যে, তাঁকে নিজের মস্তক ছিন্ন করে সেটা মেটাতে হবে। এমনকি শিবের ক্ষেত্রেও সেই রূপদান অভাবনীয় ছিল। একমাত্র হয়তো কালীই এই রূপ ধারণ করতে পারেন।
নিজের তেষ্টা মেটাতে। সহচরী ডাকিনীদের তেষ্টা মেটাতে। একজোড়া মৈথুনরত নরনারীর বুকে দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। কী আনন্দে সেক্স করছে পায়ের তলার দুজন নরনারী!
কিন্তু এই যে ভয়ানক রূপ, তার কোনো অংশ কি অন্বেষার কামুকতার মধ্যে নেই! মেয়েটা একটা কুৎসিত লজের কামরায় নিজের মর্যাদার সবটুকু তাকে দিয়ে সুখ কিনেছিল, তারপর বাথরুমের ঠান্ডা দেওয়ালে খোলা পিঠ ঠেকিয়ে কেঁদেছিল অঝোরে ... সেখানেও কি এই দেবী উঁকি দেননি! যে রিয়াকে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক সেক্স থেকে টেনে এনেছে বিকৃত এবং যন্ত্রনাদায়ক কিছু সুখের রাস্তায়, আজ সেগুলোই তার অভ্যাস হয়ে উঠেছে, তার অতৃপ্ত মুখে কখনও কি এই দেবীর পাশের ডাকিনীরা ঝলসে ওঠেনি! রিয়া আজকাল সেটা আড়াল করে না।
অনিমিখ ছিন্নমস্তার ধারণার মধ্যে ওদের দুজনকে খুঁজতে শুরু করল।
মনে পড়ে গেল বর্ণালী প্রতিহারকেও ক্লাস নাইনের ওই সরল সোমত্ত ছাত্রীটির বুকে দাঁত দেওয়ার সময় মিলন তাকে দেখে ফেলেছিল কয়েক বছর আগে, ডেকে নিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বর্ণালী পরে বোকার মতো চেয়েছিল তাকে বিয়ে করতে, বাবাকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু তাঁকে অনিমিখ ফিরিয়ে দিয়েছিল। তখন রিয়ার সঙ্গে তার বাগদান হয়ে গেছে। বর্ণালী অবিশ্যি এখন একজন সোনার কারিগরকে বিয়ে করে রাজস্থানে সুখে আছে।
মনে পড়ল সেই মেয়েটাকেও, তার সঙ্গে কলেজে পড়ত। একদিন রাতে বাড়ির ল্যান্ড ফোনে সেক্স চ্যাট করার চেষ্টা করেছিল। অপ্রস্তুত অনিমিখ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পরে আফশোস হয়েছিল। তারপর থেকে মেয়েটা কলেজে মুখ ফিরিয়ে নিত। চোখে থাকত বিতৃষ্ণা।
আবার আরেকরকমের বিতৃষ্ণা সে ভিড় বাসে বিভিন্ন বয়েসের বিবাহিতা-অবিবাহিতা কিছু মেয়ের চোখে দেখেছে, যাদের সঙ্গে সে ভিড়ের সুযোগ নিতে চেয়েছে। মুখে কিছু বলতে পারেনি, চোখ দিয়ে চাবুক মেরে গেছে তারা
সম্ভবত বয়ঃসন্ধি থেকেই অনিমিখ জীবনে পাপ করতে চেয়েছে। কবি নয়, কবিতার ব্যাপারটা তার বাগান বানিয়ে সকলের সামনে কেউকেটা হওয়ার ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়। আসলে মনেপ্রাণে ঘোর পাপী হতে চেয়েছে। এটাই তার একমাত্র অ্যাম্বিশন চেয়েছে টকটকে লাল আলোর জগতে প্রবেশ করতে। সেখানে চামড়ার রঙ চেনা যায় না। কারুবাসনার নয়, পাপকল্পনা তাকে চিরকাল নষ্ট করেছে
কিন্তু আদৌ কোনো পাপ করতে কি পেরেছে? যেটাকে পাপ ভেবেছে, সেটা আসলে হয়তো ঘটনার রোমাঞ্চ ছাড়া কিছু নয়।
পাপী হওয়ার যোগ্যতা তার হয়েছে কি? ছিঁচকে চোরকে কি গুপ্তধনসন্ধানকারী বলা যায়!
কোনটা তার জীবনের পাপ হতে পেরেছে? ভেবে দেখলে, তার নিজের যুক্তিতেই, কলেজের সেই মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেওয়াও কি পাপ না? সেদিন ওই মেয়েটা হয়তো একা একা সেক্স করার সময় অনিমিখের সমর্থনে একটু আশ্বাস পেত! মেয়েটার বরং পাপবোধ থাকত না ওই সুখের ব্যাপারটায় অনিমিখের সমর্থণ পেলে। কিন্তু অনিমিখ ভয় পেয়েছিল। নাকি, অন্বেষাকে জীবনে ডেকে আনা? কিন্তু অন্বেষা কি তাতে সেটাই পায়নি, যার জন্য সে ভিতরে ভিতরে পুড়ছিল! অয়ন কি ওকে আদৌ চরম সুখ দিতে পেরেছে! অন্বেষা নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছিল তার ধারণা। মেয়েদের শরীর সম্পর্কে অয়নের কোনো কৌতুহল নেই, শুধু প্রয়োজন আছে। বিছানায় কয়েক মিনিটের বেশি সেই প্রয়োজনের দাম নেই। মেয়েদেরও যে রতিমোচনের একটা ব্যাপার থাকে, অয়ন হয়তো তা পুরোপুরি জানে না। হয়তো এই কারণেই বৌকে সে চেনে না আজও। সেটা অন্যায় নয়, অজ্ঞতা।
অনিমিখের কাছেই অন্বেষা নিজের নারীত্বের সমর্থন পেয়েছে। সেটা কি পাপ?
হতে পারে অনিমিখ ছাড়াও আরো কারও কারও কাছে তার আগেই।
কিন্তু সেদিন মুখমেহনের পরে অন্বেষা তাকে নোংরা আর স্বার্থপর বলেছিল। পুরোটাই কি ঠাট্টা ছিল?
কিন্তু অনিমিখের অন্যায়ের কী হবে? সে তো অন্বেষার সুখের কথা চিন্তা করে মেয়েটার বিছানায় ওঠেনি! শুধু চেয়েছে নিজের যত্নে গড়ে তোলা একটা কাল্পনিক সেক্সকাহিনির সঙ্গে সেটারই ঘটমান বাস্তবের ফারাক যাচাই করতে শুধু কৌতুহল। শুধু দৌড়তে চেয়েছিল নিজের কল্পনার সঙ্গে।
কল্পনা কাউকে জিততে দেয় না। ঈশ্বরও তাই পারেননি পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে পেতে।
তারপর অনিমিখ সম্মান বাঁচাতে পাপের ধারণা খুঁজেছে নিজের কৃতকর্মে।
আজ হঠাৎ তার মনে হল, পাপ আর পাতি অন্যায়ের মধ্যে সে গুলিয়ে ফেলেনি তো! অন্বেষার সঙ্গে সে যেটা করেছে, তাতে কি রিয়ার প্রতি অন্যায় হয়েছে? রিয়া তো সেই খবর রাখে না। অন্যায় হয়েছে ... কিন্তু কার সঙ্গে ? নিজের পরিবার? নিজের মা বা মেয়ে? পৃথিবীর নিয়ম? নিজের সুপার ইগো?
অন্যায় কি সাপের বিষ, না জানলে লাগে না? অন্যায় কতটা ফণা তুললে তাকে পাপ বলা যায়?
আর অয়ন? তার চোখের দিকে কোনোদিন তাকাতে পারবে সে?
এ নিয়ে ভাবতে হবে। অনেক ভাবতে হবে হয়তো সারাটা জীবন ভাবতে হবে। সেই গেঁয়ো স্কুলমাস্টার মিলন সামন্তকে আজ একজন প্রফেট মনে হচ্ছে। ও অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছিল একদিন অনিমিখকে এই জটিলতম দিনটা দেখতে হবে
ঘটনা ঘটনা আর ঘটনা। তার বেশি নয়।
তবু, এখন, খুব বেশি না ভেবে, ইচ্ছেই যখন করছে, এখানে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ভালো
সে ছিন্নমস্তার সামনে মাথা নোয়াল। এই প্রথমবার, কোনো মন্দিরে।
না ভেবেই কথা দিল, এরপর কোনো মেয়ের দুর্দান্ত বুক দেখে দুরন্ত পাছা দেখে সেই মেয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্তহীন পিপাসাকে সে অপমান করবে না। দীর্ঘলালিত এই অভ্যাস সে ছাড়বে। ফেলে দেবে ব্লু-ফিল্মের প্রিয় সিডিগুলো। নিজের যৌন উত্তেজনার সঙ্গে লড়াই করবে। বশে আনবে নিজেকে। না পারলে শাস্তিও দেবে নিজেকে নিজেই।
এই ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে, মেয়েদের চরম প্রতীকের সামনে এ তার মানত নয়। জীবনে গভীর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দুম করেই দিয়ে ফেলল সে
বুক চিরে রক্ত দেওয়ার চেয়ে ঢের কঠিন কাজ এই আকস্মিক প্রতিশ্রুতিটাকে রাখা, সঙ্গে সঙ্গেই সে টের পেল একটি তরুণী মন্দিরের ঠান্ডা মেঝেয় মাথা ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে আছে তার সামনেই। তার লোভনীয় দেহ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অনিমিখ তার কথা রাখার প্রক্রিয়া শুরুও করল।
এই প্রথমবার। কিছু করার নেই।
হয়তো, আবার, খুব ছেলেমানুষি ও হাস্যকরভাবে। কিছু আর করার নেই।


এই কথা যে অনিমিখ সাহস করে দিতে পারল, সেটার ব্যাপারে সে নিজে যে খাঁটি তাতে সন্দেহ নেই তার নিজের তবু নিজের কাছে সেটা প্রমাণ করা জরুরি। এবার নিজেকে দন জুয়ানের বদলে দন কিহোতের ভূমিকায় সে দেখতে পাচ্ছে। এই দেখা অভ্যাস করতে হবে। নাহলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যেতে হয়।
মিলন সামন্ত জঙ্গলমহলের বুনো রাস্তায় কয়েক বছর চেষ্টা করেও এই কথা তার মুখ থেকে নিতে পারেনি। এটা কি এই প্রাচীন শহরেরই ম্যাজিক নয়! এই শহরের বাসিন্দারা কি সেই ম্যাজিক টের পাবেন? হয়তো তার মতো একজন বহিরাগতই পাবে। একজন বহিরাগত, যে তীর্থযাত্রায় নিজেকে হাস্যকর লাগবে জেনেই শুধুমাত্র অজ্ঞাতবাসে এসেছে। অনিমিখের মনে হচ্ছিল বাসস্ট্যান্ডে বিষ্ণুপুরের বাসটিকেই তার বেছে নেওয়াটা নিছক কাকতালীয় যোগাযোগ নয়। এই শহরটাকে সে চাইছিল মনেপ্রাণে। এই শহরের পোড়ামাটির মন্দিরগুলো, তাদের যুগের পর যুগের নির্মম পটপরিবর্তন সহ্য করতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে চোরেদের ছেনি-বাটালির আঘাতে খুলে নিয়ে যাওয়া টেরাকোটার অপরূপ কারুকাজগুলোর একে একে মুছে যাওয়ার শোক। তবু স্থাপত্যগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আজ অনেকের বুকে বিগ্রহও নেই, কিন্তু তারা গরীব হতে দেয়নি নিজেদের। মানুষ কোনো দৈবী প্রসাদের লোভ ছাড়াই তাদের মহিমার সামনে মাথা নোয়াচ্ছে। জমাট বাঁধা সময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমারতগুলো এই হিম ঠান্ডায়।
জোড়বাংলো মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবল, এই সব মন্দির বিকেলের রোদে মানুষকে স্থায়ী হয়ে ওঠার উসকানি দিচ্ছে, প্ররোচিত করছে উঁচু হয়ে ওঠার জন্য, সময়কে পেরিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক সাহিত্যে এই কথা লেখা হয়েছে, তাঁরা টের পেয়েই লিখেছেন। কয়েকজন ইউরোপীয় বা আমেরিকান ঘুরে বেড়াচ্ছে মন্দিরের মধ্যে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। ওরাও সেটা টের পেয়েই এতদূর এসেছে, এসে ঠকেনি।
বঙ্গীয় স্থাপত্যের এই উসকানির মধ্যে প্রেম আছে। সেই প্রেমের অংশ না পেলে কবি হওয়া যায় না, জীবনসঙ্গী হওয়া যায় না, বাবা হওয়া যায় না।
অবিশ্যি ‘স্তন’ আর ‘যোনি’ শব্দদুটো বারবার লিখে কবি হিসেবে নাম কেনা যায়।
আজ নাম কেনা একেবারেই কঠিন কাজ নয়।

হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। রাতে নাকি এই শহরে সাপের উপদ্রব। মল্ল রাজাদের অনেক সুড়ঙ্গ নাকি আছে শহরের তলায়। সেখান থেকে সাপ উঠে আসে শহরের রাস্তাঘাটে। মৃন্ময়ী মাতার মন্দিরে নাকি সাপগুলো ঘোরাফেরা করে রাতে।
এই শীতকালে সেটা সম্ভব নয়। অবিশ্যি কিংবদন্তি তাতে থেমে থাকে না।
ফিরে এসে হোটেলের একতলায় রাতের খাওয়া সেরে নেয়। তারপর নিজের ঘরে এসে অনেকটা মদ খায়বিষ্ণুপুরে প্রতি রাতেই সে মদ খেয়েছে। ঘরের জানালা খুলে বসে থাকে। কয়েকটা সিগারেট টানে পরপর। অন্বেষার মেসেজ সাধারণত রাত এগারোটার পরে ঢোকে। সেই সময়টা এগোতে থাকে, তার বুকের অস্থিরতা বেড়ে যায়। একেক টানে সিগারেটের অনেকখানি পুড়ে যেতে থাকে।
আজ ভাবছিল রিয়াকে ফোন করবে। মেয়েটা কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে। বাবাকে কি মিস করছে খুব? মায়ের শরীর কেমন আছে? কিছু সমস্যা হলে অবিশ্যি জ্যোতির্ময় হালদার আছেন। কিন্তু ওঁর শরীরও আজকাল ভালো যাচ্ছে না। একদিন বাজারে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন শুনেছে সে রিয়ার মুখেই। যৌবনে অনেক অত্যাচার করেছেন শরীরের উপরে। এখন শরীর তার হিসেব আস্তে আস্তে বুঝেই নেবে।
সবকিছুই সব হিসেব কেন বুঝে নিতে চায়?
বাইরে বিষ্ণুপুর শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। এই হোটেলের ঘর থেকে অন্ধকারে তাকে একটা সাদামাটা মফসসল শহর ছাড়া কিছু মনে হয় না। তার কোনো ইতিহাসই টের পাওয়া যায় না। দূরে কোনো বিয়েবাড়িতে বাংলা সিনেমার গান বাজছে। দেবের সিনেমা। বিষ্ণুপুরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে উত্তরাধিকার, তার কোনো রেশ সেই গানে নেই। অনেকের কাছেই এই শহর অনেক পুরনো মন্দির আর অসংখ্য টেরাকোটা আর ঢোকরা শিল্পের দোকানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণমেয়েরা কলকাতা থেকে আসে এখান থেকে বালুচরী স্বর্ণচরী কিনতে, পোড়ামাটির গয়না কিনতে। অনেকে সপরিবারে আসে মদনমোহন বা ছিন্নমস্তার মন্দিরে পুজো দিতে, মানত করতে, মানত পূর্ণ করতে।
এই শহর অনেককে জীবিকা দিয়েছে। তারা শিল্প বেচে, ইতিহাস বেচে, ধর্ম বেচে, এমনকি ট্যুরিস্টদের চা-জলখাবার বেচে নিজেদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর ফলেই বেঁচে আছে শহরটি। এখন ঢোকরা শিল্পের গায়ে সোনালি পালিশ লাগাতে হয়, তবে বিক্রি হয়, তার আদি চেহারায় পড়ে থাকে দীর্ঘকাল কোনো রসিকের আশায়। সময় আবার বদলে গেছে এই শহরেরকিন্তু সে বেঁচে আছে।
রাত বাড়ছিল। আজ একটু বেশি দেরি হচ্ছে মেসেজ আসতে।
অন্বেষা ঘুমিয়ে পড়েনি তো!
অনিমিখকে তাহলে সারারাতই পেঁচার মতো উদ্বেগ নিয়ে জেগে থাকতে হবে।
সে আর বসে থাকতে পারছিল না। ভয়টা বাড়ছিল। সিগারেট ধরিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল। আবার তার মাথায় খুব বিশ্রী সব চিন্তা আসছিল। ভয় আর মদ মিলে গিয়ে আবার মনে হচ্ছিল অয়ন আজ অন্বেষাকে খুন করে ফেলেনি তো! সব কি জেনে ফেলেছে কোনোভাবে!
মেসেজ এল সাড়ে এগারোটার পর, এল অন্বেষার সেই পুরনো নম্বর থেকে – aar bhoy nei. o oi byapaar nie aar vaabchhe naa bolei mone hoe. otaa mite gechhe. aamake phone firiye diyechhe. tumi baari fire jaao. aami 2-1 diner modhye jogaajog korbo. good night.
    অনিমিখ একটা বিরাট শ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল তাকে কারাদন্ড থেকে এইমাত্র মুক্তি দেওয়া হল। যেন ডাক্তার তাকে এইমাত্র বললেন কোনো দূরারোগ্য ব্যধি তার হয়নি, সে ভরপুর অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে এবার পৃথিবীর বাতাসে
অনিমিখ সোল্লাসে প্যাকিং শুরু করল।


পরের দিন খুব ভোরে যখন অনিমিখ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য রিক্সায় চড়ে বসল, তার চোখ গেল রাসমঞ্চের দিকে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমারত সকালের কুয়াশা আর রোদে। অনিমিখের মতোই অনেককে সে তাকে ভালোবাসতে এবং চলে যেতে, এমনকি মরে যেতে দেখেছে। স্থাপত্যের হৃদয় তো এইজন্যেই শক্ত জলহীন পাথর দিয়ে বানানো হয়, যাতে সে সস্তা আবেগে লোকের সামনে খেলো না হয়ে যায়, খসে না পড়ে
অনিমিখের খুব খারাপ লাগছিলএই কয়েকটা দিনে এটা যেন তার নিজের শহর হয়ে উঠেছিল। আবার হয়তো ফিরে আসবে। হয়তো ফ্যামিলি নিয়ে আসবে, আনন্দ করবেতার মেয়ে ছুটে বেড়াবে রাসমঞ্চ ঘিরে। অনিমিখ রিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে দেখবে আহ্লাদ করে।
কিন্তু এই কয়েকটা দিন আর ফিরে আসবে না। এই কয়েকটা টালমাটাল দিন, যখন সে একটা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিজের জীবন এবং পরিবারের দিকে তাকিয়েছিল

এই অনিমিখ চক্রবর্তী আর ফিরে আসবে না বিষ্ণুপুরে।