৩য় অধ্যায়



নতুন স্কুলে এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরে অনিমিখ বুঝল মাস্টারদের আসলে একটাই সমাজ স্কুল বড়ো হতে পারে, ছোট হতে পারে, মাস্টারদের কাজের চাপ বাড়তে পারে, কমতে পারে, তাঁদের যাতায়াতের দূরত্ব কমতে পারে, বাড়তে পারে, তাঁরা শহরবাসী হতে পারেন, গ্রামবাসী হতে পারেন, বিভিন্ন বয়সী হতে পারেন, এমনকি নারী অথবা পুরুষ হতে পারেন, সকলেই শিক্ষকসুলভ পোশাকও আজকাল আর পরেন না, কিন্তু তাঁদের দেখলেই চিনে নেওয়া যায়প্রায় নির্ভুলভাবে বোঝা যায় তাঁরা কোনো না কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অথবা মহাবিদ্যালয়ে পড়ান অবশ্যই এই বিরাট সমাজটি বিভিন্ন উপ-সমাজে বিভক্তকিন্তু তাঁদের শনাক্ত করতে সমস্যা হয় না পেশা তাঁদের অলক্ষ্যে বদলে দেয়, ঠিক যেমন অন্যান্য পেশাগুলোও দেয় একজন পুলিশকে, উকিলকে, ব্রোকারকে, অথবা ডাক্তারকে দেখলেই যেমন চিনে নেওয়া যায়, অন্তত সন্দেহ হয় তিনি ওই কাজটিই করেন
কিছু মানুষ শিক্ষকতার পেশার মধ্যে থেকেই সাহিত্যে সোনার ফসল ফলিয়েছেনছাত্ররা তাঁদের দেবতা ভেবেছে, সারাজীবন তাঁদের স্মৃতি মনে রেখেছেতাঁরা শিক্ষকতাকে চাকরি ভাবেননি, আবার নিজেদের শুধুমাত্রমাস্টারভেবে একটা ছকের মধ্যে আটকেও ফেলেননি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো একজন শিক্ষকই ছিলেন! এই পেশার মধ্যে না থাকলে তিনি ‘অনুবর্তন’-এর মতো উপন্যাস লিখতে পারতেন কি!
কিন্তু অনিমিখ খুব ভাল করে জানে সে কোনদিনই মনেপ্রাণে একজন শিক্ষক হতে পারবে নাএকটা ভয় তার মধ্যে সবসময় কাজ করেনিজস্বতা হারিয়ে ফেলার ভয়সেটাই হয়তো তাকে আর পাঁচজনের চেয়ে দূরে রাখেআটকে রাখে
সেটা কি অনিমিখের মাঝারিয়ানারই প্রমাণ? প্রবাদবাক্যের সেই মধ্যমের মতোই কি সে তফাতে রাখে নিজেকে? বাঁচিয়ে রাখে নিজের ছিটেফোঁটাগুলো? অনিমিখ ভেবেছে। কিন্তু খুব বেশি ভাবতে চায়নি।
মোরগমারির মতোই এই নতুন স্কুলেও অবিশ্যি অনিমিখ নিজেকে বেমানানই বোধ করছে এই বিশেষ সমাজের অন্তর্ভুক্ত সে হতে পারেনি, হয়তো হতেও চায়নি কখনওএই পেশার জন্য এক বিশেষ মানসিক ধাঁচ প্রয়োজন হয়, হয়তো সেটাকে আত্মনিবেদনও বলা চলেতার সেটা নেইনিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে একটা ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে ওঠার তাগিদটাকেই সে এড়িয়ে চলে স্কুলের বাইরে কেউই তাকে দেখে বুঝতে পারবে না সে একজন মাস্টারমশাই এই কারণেই আগের স্কুলে তাকে উন্নাসিক ভাবা হত সে স্টাফরুমে বসে থাকলে আড্ডা জমত না কিছুদিন পরেই এখানেও হয়তো সেটা ঘটবে
ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষক হয়ে ওঠা তার হয়তো হবে না এই জীবনে
এই এক সপ্তাহের মধ্যে সত্যিই অনিমিখ মাস্টারমশাইদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করায় মন দিতে পারেনি এমনকি স্কুলের নামকরা লাইব্রেরিটিতেও একবার উঁকি দিতে পারেনি ক্লাস নিয়েছে ক্লাসের ফাঁকে অন্বেষাকে মেসেজ করেছে, ফোন করেছে টয়লেটে লুকিয়ে, বা টিফিনে সেই একইভাবে নদীর পাশে গিয়ে
সন্দেহ নেই এই স্কুলে অনিমিখকে আরো রহস্যময় মানুষ ভাবা হতে পারে হয়তো ইতিমধ্যেই ভাবা শুরু করে দিয়েছেন অনেকে
এমনকি অপছন্দও

অন্বেষাকে সেটা বলতে সে হাসল, বলল, ‘এখানেও তো আপনি ওটাই করতেনআমরা সকলে তাই আপনাকে ভয় পেতামকিন্তু আমাকে এত ফোন করছেন, মেসেজ করছেন, ওই স্কুলের কেউ নোটিশ করছে না?’
এখন অনিমিখ অন্বেষাকেতুমিবলা শুরু করেছেফোনের নিষেধাজ্ঞাটা সে অন্বেষাকে জানায়নিতাই বলল, ‘হয়তো লক্ষ্য করছে, কিন্তু তোমাকে যে ফোন করছি সেটা তো আর জানতে পারছে না!’
অন্বেষা হাসল, ‘হয়তো ভাবছে বাড়ির পাশের স্কুলে এসেও মাস্টারমশাইয়ের বৌয়ের জন্য খুউউব মন খারাপ করে, ওকেই ফোন করেন লুকিয়ে লুকিয়ে
ওকে ফোন করে তো কোনো লাভ নেই অন্বেষা! হয়তো মেযেকে পড়াচ্ছে, বা মায়ের সেবা করছে, বা স্নান করতে ঢুকেছে…’
সেগুলো বুঝি খুব খারাপ কাজ?’
খারাপ অবশ্যই নয় আছে বলেই আমাদের সংসারটা চলছেতবে বিরক্ত হতে পারে কাজের মধ্যেকিংবা, বলবে স্কুল থেকে ফেরার পথে দেড় কেজি মুগডাল কিনে নিয়ে যেতে
অন্বেষা প্রান খুলে হেসে উঠল, ‘সে তো বলবেই! আপনি না কিনে নিয়ে গেলে কে কিনবে? আর যত্ন করে সেই ডালটা তো আপনার জন্যই রাঁধা হবে তাই না? কবিকেও তো খেতে হয়! শুধু মাস্টারমশাইদেরই আছে, কবির বুঝি খিদে নেই?’
আছে অন্বেষাঅন্যদের চেয়ে বেশিই হয়তো আছে
কথা বলার ভঙ্গিতে কথাকে পেরিয়ে গেল অনিমিখপেটের খিদেকে পেরিয়ে গেলঅন্বেষা চুপ করতে বাধ্য হলওই কথা এইভাবে বললে পৃথিবীর যে কোনো সুস্থ মেয়ে চুপ করে যায়মিলন সামন্ত হয়তো এই সময় সাবধান করে দিত, হয়তো বলত মেয়েটা ফোনের ভিতর থেকে থাপ্পড় মারবে, কিন্তু সেটা হওয়ার নয়, কোনো মেয়ে সেটা করে বলে অনিমিখের মনে হয় নাদুজনের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের এই যে নীরবতা নেমে এসেছে, অনিমিখ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানে, এর পরে পর্দাটা আরো উঠবেঅনিমিখের বুক শান্তই ছিলপ্রায় এক অভিজ্ঞ প্লে-বয়ের মতো সে এগোচ্ছে এখন এই সম্পর্কটায়এই তিন-চারদিনে তার চিত্রনাট্য একটাও অপ্রত্যাশিত মোড় পায়নিসে জানে, সে টের পাচ্ছে, গভীর জলের মধ্যে একটা বিরাট মাছের মতো অন্বেষাও তার চিত্রনাট্যের খেয়াল রাখছে, উপরের তলে ভেসে উঠতে চাইছে, রোদ্দুর মাখতে চাইছে সারা গায়ে
অন্বেষা বলল, ‘আপনি কী চাইছেন আমার কাছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু আমি এবার করতেই পারি
উত্তরটা অনিমিখের তৈরিই ছিলএক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বলল, সাহচর্য! সঙ্গ! বন্ধুত্ব! আমি খুব একা অন্বেষা
একজন বিবাহিত পুরুষ এই কথাটা বলার পরেই একজন মেয়ের কিন্তু ফোনটা কেটে দেওয়া উচিত!’
কিন্তু তুমি কাটছ না! এবং তুমিও বিবাহিতা! হয়তো একা, ঠিক আমার মতোই!’
পার্থক্য আছে, অনিমিখদাঅনেকখানি কষ্ট এসে মিশল অন্বেষার গলায়এই প্রথম সে অনিমিখকে স্যারের বদলে অন্য সম্বোধন করল
খুব কোমল গলায়, প্রায় আদরের মতো করে অনিমিখ বলল, ‘সত্যিই কি আছে? কোনো পার্থক্য? আমি তো টের পাচ্ছি না
কী করে পাবে? কতটুকু জানো তুমি আমার সম্পর্কে? কিছুই তো জানো না! আমি নামেই বিবাহিতাকিন্তু তুমিতুমি একজন সুখী স্বামী, একটা ফুটফুটে বাচ্চার বাবাতুমি আমার সঙ্গে কেন জড়াতে চাইছ নিজেকে? খেলা? জীবন নিয়ে?’
অনিমিখ টের পাচ্ছিল তার কল্পনাকে এবার হারিয়ে দিচ্ছে অন্বেষামেয়েটা হয়তো নিজেই জানে না কখনতুমিবলতে শুরু করেছে তাকে কিংবা খুব ভালো করে জানে। তারই মতো রিহার্সাল করেছে আজ। তবে ঠিকভাবে রাশ না টেনে ধরলে এই মহামুহূর্তটি পিছলে গিয়ে অনিমিখের হাত ফাঁকা করে দেবে
অনিমিখ বলল, ‘জীবন নিয়ে খেলা নয়জীবনের চাহিদা
শরীর? সেটাই বলো  তীব্র গলায় বলল অন্বেষা, ‘সেই খিদেটার ইশারাই দিলে একটু আগে?’
এবার খুব তৈরি গলায় অনিমিখ বলল, ‘ছিঃ! এটা তুমি বলতে পারলে?’
টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে আসছিলআজকাল হয়তো তার উপস্থিতির কারণেই নদীর দিকে ছাত্ররা সেইভাবে আসে নাদু-তিনজন ছিলতারা স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছেতার দিকে মাঝেমাঝে কৌতুহলের দৃষ্টিও দিচ্ছেসেটা স্বাভাবিকএইভাবে নদীর ধারে রোজ রোজ এলে সকলেই সন্দেহ করবেসমস্যাও হতে পারে স্কুলে
অনিমিখ স্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করলবলল, ‘এটা তোমার কাছে শুনবো, ভাবিনি অন্বেষা! কিন্তু এটাই বোধহয় বাস্তব! আমাদের সমাজে তো মন আর শরীরকে আলাদা করে ভাবা হয় নাএকই মনে করা হয়আমার সেভাবে ভাবার অভ্যাসটা নেইতোমার থাকতেই পারে, আমার মনে রাখা উচিত ছিল
অন্বেষা উন্মুখ গলায় বলল, ‘তুমি রাগ করবে না কিন্তু! আমার খারাপ লেগেছিল তোমার খিদের কথাটাকে নিজেকে খাবার ভাবতে চায় বলো?’
কেউ চায় নাআমি জানি কেউ চায় নাআমি তোমাকে খাবার ভাবি না অন্বেষাআমি তোমাকে ঠিক নিজের মতো ভাবি, আরেকটা অনিমিখ, বা আমিই হয়তো আরেকটা অন্বেষা, একটা অন্যরকম শরীরে! কোনো জোর নয়, অন্বেষা, জোর তোমার উপর আমি খাটাবোই না, সেই অধিকারও আমার নেইকিন্তু বিশ্বাস করো, গত কয়েকটা বছর আমি শুধু তোমাকেই চেয়ে গেছি, অবিরামতুমি না থাকলে আমি ওই স্কুল ছেড়ে পালিয়ে যেতাম
পালিয়েই তো গিয়েছ! আছো কি আর আমার সঙ্গে!’
দূরে না এলে তোমায় হতো না পাওয়া! এখন রাখছিরাতে কথা বলি? ফোন করব?’
ইচ্ছে হলে, কোরো আজ নেইকলকাতায় মিটিং করতে গেছে
বেশরাত্তিরে ফোন করছি তাহলেসাড়ে আটটার পরটাটা
টাটা

টিফিনের পরে তার আরো ৩খানা ক্লাস ছিলঅনিমিখ পড়ানোর সময় অন্যমনস্ক হয়ে রইল
আজও অন্বেষা তার কল্পনাকে পেরোতে পারেনিঅবাক করে দিতে পারেনি তাকেতবে কি নিজের জীবন নিয়ে যে খেলাটা অনিমিখ খেলছে, তার শেষে সে জানতে পারবে কল্পনা আর স্মৃতির মধ্যে আসলে কোনো ফারাক থাকে না? এই অনুভূতি থেকে সে তো বেরোতেই পারছে না যে, এই ঘটনাগুলো তার মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই ঘটে আছে! তার মনে হচ্ছে অন্বেষার প্রতিটি সাড়া সে চিনতে পারছে, প্রায় একটা সেক্সি পুতুলের মতো সে নাচিয়ে চলেছে মেয়েটাকে!
কোনো বাধা নেই
যেটুকু বাধা আসছে, তা নিজের সঙ্গে দাবা খেলার মতোই
এতে তার জয় কোথায়? একজন চরম নিঃসঙ্গ মেয়েকে মিষ্টি একটা সম্পর্কের লোভ দেখালে, খুব মর্যাদার সঙ্গে ফুসলানি দিলে, সে তো এভাবে সাড়া দেবেই! সেটা যে শুধু মেয়েটির শারীরিক পিপাসা, তা- ভেবে নিয়ে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ খুব বেশি নেই
ঠিক যেমন সুযোগ নেই এই খেলা শুরু করে এখন আর বন্ধ করার
খেলাটা তাকে চালাতে হবে, একটা অপ্রত্যাশিত পয়েন্ট লক্ষ্য করে, যেখানে তার কল্পনা তাকে নিয়ে যেতে পারবে না
শালা, কল্পনাকে হারতেই হবে তার কাছে।

বাড়ি ফিরে দেখল সবাই মিলে টিভিতে সিনেমা দেখছেমা আজও নিচে নেমে এসেছেঅমিতাভ বচ্চনেরহামচলছে একটা চ্যানেলেআজ থেকে বছর কুড়ি আগে, যখন এই সিনেমা বেরিয়েছিল, অনিমিখ তখন কিশোরতখন এই সিনেমার নামও তাদের মুখে আনা চলত নাজুম্মা চুম্মা দে দেগানটাই ছিল তার কারণআজ সময় সত্যিই বদলে গেছেতার মেয়ে আজ বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে এই সিনেমাটা দেখছে
পোশাক বদলে এসে অনিমিখও বসল সিনেমাটি দেখতেজ্যোতির্ময়বাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় এই ফিল্মটা খুব দেখতে চাইতাম, বাবা-মা- ভয়ে দেখতে পারিনিএরকম আরেকটা ছবিও দেখতে পারিনি- রামগোপাল ভার্মাররঙ্গীলাবন্ধুরা লুকিয়ে দেখেছেতাদের মুখে গল্প শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে
জ্যোতির্ময়বাবু হেসে উঠলেন, অনিমিখের মাকে বললেন, ‘শুনছেন তো, সন্তানের কত অভিযোগ থাকে, কিশোরবেলায় তাদের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করায়?’
মা- হাসল, ‘তখন সময় আলাদা ছিলআজ তো সোনুও আমাদের সঙ্গে বসে আছে দেখুন, ওর মা আপত্তি করছে না
রিয়া বলল, ‘আপত্তি করলেই শুনবে নাকি? তাহলে তো এই ছবি বন্ধ করে কার্টুন নেটওয়র্ক চালাতে হবে!’
জ্যোতির্ময়বাবু বললেন, ‘আসলে সত্যিই সময়টা আলাদা হয়ে গেছেএখন সন্তানরাই শাসন করছে বাবা-মাকেসেটাই মনে হয় না? তাদের ইচ্ছেতেই চলছে পরিবারগুলো, মানে যে পরিবারগুলো আজ আর একান্নবর্তী নেইসেখানে তো আজ আর বলার মতো কোনো ফাদার-ফিগারও নেই আগের মতো! একেবারের প্রথম থেকেই বাচ্চারা বুঝে ফেলছে তারা তাদের পরিবারের চোখের মণি, তাদের একটু চোখের জলও কেউ সইতে পারবে নাআমাদের বেলায় এটা ছিল নানিজেদের গুরুত্ব বুঝতে বুঝতেই পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসে পড়তএকটু থামলেন উনিতারপর আবার বললেন, ‘তবু কোথাও আমরা পুরোপুরি বদলাতে পারিনি নিজেদেরফেসবুকের যুগে এসেও কিছু ব্যাপারে অনড় রয়ে গেছিঅথচ সেগুলোই বদলানোর দরকার ছিল
অনিমিখ বেশ মন দিয়ে শুনছিল ওঁর কথাজিজ্ঞাসা করল, ‘যেমন?’
যেমন আমরা আজও বিশ্বাস করতে পারি না মানুষ বহু সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়েই বাঁচে, বাঁধা সম্পর্কের বাইরে গিয়ে বাঁচে। সে ঠিক ফাঁক খুঁজে নেয়। তাকে আটকে রাখা যায় না আটকে রাখলে সে বাঁচে নামানুষ হয়ে বাঁচে নাপুতুল হয়ে যায়
অনিমিখ হাসল, ‘সকলে এটা বলতে পারে নাসকলে কি পারে বাড়ির সদর দরজায় খিল না লাগিয়ে রাত্তিরে ঘুমোতে?’
সেটাই যদি না পারে, তাহলে আর কী সভ্যতার বড়াই?’
সভ্যতায় বড়াইয়ের সুযোগ আর কই? লড়াইয়ের সুযোগটাই বেশি নয় কি?’
দারুন বলেছ অনিমিখ! চ্যাপলিনের সেই সিনেমাটা মনে পড়ে গেলমঁসিয়ে ভের্দুশেষ দৃশ্যে চ্যাপলিনের সংলাপটা মনে আছে তোমার?’
আছেবোতাম টিপে যারা হাজার-হাজার মানুষকে মেরে ফেলে তারা রাষ্ট্রনায়ক, আর বেঁচে থাকার জন্য যে মানুষটা হত্যা করে অন্য মানুষকে, সে হয় খুনীখানিকটা এরকমই বোধহয় বলেছিলেন উনি
কিয়েসলওয়াস্কির শর্ট ফিল্ম এবাউট কিলিং’ … সেখানেও প্রায় একইরকম ব্যাপার, তাই না? হত্যাকারী ছেলেটিকে যখন টেনে হিঁচড়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছেউফ! কী বীভৎস! আমি দ্বিতীয়বার আর ছবিটা দেখার সাহস করিনিযেমন স্ট্যানলি কিউব্রিকের ক্লকওয়র্ক অরেঞ্জদেখতেই পারিনি আমি কিছুটা এগনোর পরএটা কখনো ভেবেছ, আমাদের এখানে সিনেমায় ভায়োলেন্সকে তবু অনেকখানি ছাড় দেওয়া হয়, যৌনতাকে সেইভাবে জায়গা দেওয়াই হয় না? অথচ, দ্যাখো, হিংসার চেয়ে অশুভ কিছু আছে কি? ওটা তো মানুষকে মানুষ রাখে না! ধর্ষণ কিন্তু যৌন অপরাধ নয় আমার মতে, ওটা হিংসা থেকেই ঘটে দিল্লির ওই যে তরুণীটির সঙ্গে কিছু ছেলে যেটা করল, ওটাই দ্যাখো। ওরা কি কামুক, নাকি হিংস্র? কাম যতই প্রথম রিপু হোক, সে মানুষকে সুন্দর করে, কুশ্রী করে নাবিদেশের ইরোটিক সিনেমাগুলো দেখলে সেটা বোঝা যায়যেমন বৈষ্ণব পদাবলী পড়লে জানতে পারি ব্যভিচার আসলে একটা নকল শব্দওটা আসলেব্যতিক্রমহবে
অনিমিখ আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালমা কানে কম শোনে আজকালঅবিশ্যি সেটা খেয়াল করে জ্যোতির্ময় শেষের কথাগুলো বলেননিউনি অত হিসেব করে কথা বলেন নামেয়ের কাছাকাছি বয়সী অনিমিখের কাছে চেয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাতে ওঁর বাধে নাশোনা যায় একসময় গাঁজা খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেন। বাড়ির লোক গিয়ে তুলে আনত। আজ অবিশ্যি ওঁর বাড়িতে তুলে আনার কেউ নেই। অনিমিখ বা রিয়াকেই যেতে হবে। তবে এখন আর ওসব উনি করেন না। মুখে মৃদু মদের গন্ধ অবিশ্যি প্রায়ই পাওয়া যায়।
অনিমিখের সঙ্গে কথা বলতে খুব পছন্দ করেনছুটির দিন ছাড়া এর আগে সুযোগ পেতেন না, এবার পাবেনঅনিমিখও নিজেকে সমৃদ্ধ বোধ করে এই লোকটির সঙ্গে আলোচনার পরএকটি ছোট শহরে থেকেও, লেখালেখি বা সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কোনোরকম প্রত্যক্ষ লেনদেন না রেখেও সেচ বিভাগের সাধারণ কর্মচারী জ্যোতির্ময় হালদার নিজেকে কী করে তৈরি রাখেন এই ধরণের আলোচনার জন্য? ওঁর বাড়িতে অবিশ্যি বইয়ের শেষ নেই সিনেমা আর গানের সিডির ইয়ত্তা নেইএই শহরে ইন্টারনেট ব্যক্তিগতভাবে উনিই প্রথম ব্যবহার করেছিলেনএখনও নিয়মিত ফেসবুক করেনওঁর বন্ধুতালিকায় কলকাতার অনেক বিরাট-বিরাট নাম আছেনঅথচ নিজে জীবনে কিছু লেখার বা তৈরি করার চেষ্টা করলেন না!
হয়তো ওঁর চেয়ে অনেক কম ক্ষমতা নিয়েও অনিমিখ আজ কবি হিসেবে নাম কিনেছে, শুধু ইচ্ছের জোরে
এভাবেও বলা যায়, অনিমিখ নিজেকে কবি হিসেবে কল্পনা করেছে সেই কৈশোর থেকে, আজ সে তাই বিভিন্ন নামী পত্রিকার সূচীপত্রে নিজের নাম দেখতে পাচ্ছে নাম কি আর সত্যিই অত দামি!

জ্যোতির্ময়বাবু চলে যাওয়ার পর সে কম্পিউটারের সামনে বসলকিছু মেলের উত্তর দিলকয়েকটি মেল করলএকটি আন্তর্জাল পত্রিকাকে কবিতা পাঠালএইসব শেষ হতেই ঘড়িতে সাড়ে আটটা বেজে গেলরিয়া কফি দিয়ে গেলসেটা শেষ করে রাস্তায় বেরোলআগে বারমুডা পরেই বেরনো চলত, এখন আর সেটা হবে না, সে এখন স্থানীয় শিক্ষকযে কোনো মুহূর্তে টিউশন পড়তে যাওয়া কোনো ছাত্রের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারেএখন আর অনিমিখ স্থানীয় কোনো সিডি শপে পর্নোগ্রাফি কিনতে পারবে নাসিগারেট যে কোনো দোকানে কেনা যাবে নামদ তো এই শহরে আর কেনাই যাবে না

বাইরে বেশ ঠান্ডাশীতকালের এই সময়টা গোয়েন্দা গল্পের স্মৃতি মনে এনে দেয় অনিবার্যভাবেখোলা মেজাজে অন্বেষার নম্বর লাগাল অনিমিখ
স্যুইচড অফ!!!
পরের প্রায় এক ঘন্টা অনিমিখ রাস্তাতেই থাকল। বার পঞ্চাশেক অন্বেষার নম্বর লাগাতে চেষ্টা করলপ্রতিবারই স্যুইচড অফ শোনা গেল
তবে কি ওর বর ফিরে এসেছে?
নাকি, পিছিয়ে গেল? সেটাই কি বুঝিয়ে দিচ্ছে এভাবে?
তবে কি অনিমিখ চক্রবর্তীর কল্পনার দৌড় এখানেই শেষ? বাকিটা খোশখেয়াল ছিল?

ঝোড়ো মন নিয়ে অনিমিখ বাড়ি ফিরলরাতের খাবার খেল