একেবারে পরের দিন সকালে স্কুল যাওয়ার আগেই ফোন অন করল অনিমিখ। করা মাত্রই আরো কিছু মেসেজ একের পর এক এসে ঢুকলো তার ফোনে। সবগুলোই অন্বেষার নম্বর থেকে আসছে। প্রতিটিতে হিংস্র কৌতুহল, কেবল শেষেরটিতে লেখা আছে – evaabe keno lukie thaakchho tumi? keno
kosto diccho amake?
এই মেসেজগুলোর কোনোটাই অন্বেষার হতে পারে না। ওর ফোন এখন ওর হাতে নেই। অবশ্যই অয়ন ফোনটিকে হস্তগত
করেছে। মাথা খাটিয়ে বের করার চেষ্টা করছে বৌয়ের কোনো গোপন প্রেমিক আছে
কিনা।
এবং অয়ন অনিমিখের নম্বরটিকেই ঘোরতর সন্দেহ করেছে। আশা করা যায় অনিমিখের নম্বর তার নামসমেত অন্বেষা নিজের ফোনে সেভ
করেনি। ওর ফোনে নিশ্চয়ই অনিমিখের কোনো চিহ্ন নেই। সেটা হলে সন্দেহের জায়গা থাকত না, এই মেসেজগুলোও আসত না। হয়তো অয়ন এসে উপস্থিত হত সশরীরে। হাতে খোলা ছুরি নিয়ে, বা না নিয়ে।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এখন অনিমিখের নাগালে একেবারেই নেই। তার কল্পনাশক্তি, তার পাপের ধারণা, এইসবের সঙ্গেই পরিস্থিতিও তার হাত ছেড়ে
অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়
নেই। সেটাও করতে হবে একেবারেই শান্ত থেকে। মুখ বন্ধ রেখে। কিন্তু ফোনটি বন্ধ রাখা চলবে
না। তাহলে অন্বেষার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু, সে বুঝবে কী করে অন্বেষা তার
সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে? ওর নম্বর থেকে ফোন এলে ধরার প্রশ্নই
নেই, অন্য কোনো অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলেও কি ধরা ঠিক হবে?
সেটাও তো টোপ হতে পারে!
কোনো অচেনা ফোন ধরাই চলবে না। একেবারেই না।
হঠাৎ মাথায় একটা আরো বিশ্রী চিন্তা এল। অন্বেষা বেঁচে আছে তো? অয়ন বৌকে মেরে ফেলেনি তো? লোকটার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছে
সে, সেটা আদৌ অমূলক চিন্তা নয়। কোনো একটা টেন্ডারের ব্যাপারে অয়ন একটা মার্ডার কেসে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে
আছে, সে শুনেছে। ওর হাতে কিছু পোষা গুন্ডাও নাকি আছে। ঠিকাদারির ভিতরে এবং বাইরে ওর যেসব ধান্দা, সেখানে তাদের কাজে লাগায় ও। হেঁটে স্কুল যাওয়ার পথে অনিমিখ টের পেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা
হিমেল স্রোতটি। অবাক হয়ে টের পেল, অন্বেষার মৃতদেহের বদলে সে এখন নিজের কথাই ভাবছে! অন্বেষা
খুন হলে সে নিজেও তো বাঁচবে না! এমনভাবে জড়িয়ে পড়বে, খুব কাপুরুষের মতোই সে কেঁপে উঠল ভেবে, তার জীবন শেষ
হয়ে যাবে। রিয়ার সামনে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে সে কি আর! চাকরি যাবে। পরিবার যাবে। আরো ভয়ানক একটা ব্যাপার আছে।
সে নিজেই এখন খুন-টুন হয়ে যেতে পারে।
বেশ কয়েকবার পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে অনিমিখ স্কুলে পৌঁছল। বুঝল, কবি হওয়ার লোভ ছাড়াও মধ্যবিত্ত ছাপোষার একটা গুণ তার মধ্যে ষোল আনা আছে।
সেটা প্রাণের ভয়।
সেটা আর সে নিজের কাছেও লুকোতে পারবে না।
স্কুলে এখন তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। মাস্টারমশাইরা তাকে ফাঁকিবাজ ভাবেন। তার গা থেকে ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধে নাক কোঁচকান। ছাত্ররাও খুব আগ্রহী হয়তো নয় তাকে নিয়ে। কেউই নিজের থেকে কথা বলতে বা জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে আসে না। এই স্কুলে তার বেতন এখনও চালু হয়নি। কাগজপত্রের কিছু ব্যাপার মিটলেই সেটা চালু হবে। অবিশ্যি বকেয়া বেতন একইসঙ্গে পেয়ে যাবে। সেই ব্যাপার নিয়ে প্রথম পিরিয়ডটা তাকে অফিসেই কাটাতে হল। এরপরে টিফিন অবধি তার টানা তিনটি ক্লাস আছে। সেই ভূগোল শিক্ষক আজ আবার আসেননি। ভদ্রলোক নাকি অসুস্থ। তাঁর একটি ক্লাস তাকে আজ নিতে হবে।
এর মধ্যে অনিমিখ নিজেকে বোঝাতে সচেষ্ট হল, অন্বেষা অবশ্যই খুন হয়নি! বড্ডো বেশি ভেবে ফেলছে সে! তবু কোনো গোলমাল হয়েছে কিনা, জেনে নেওয়ার একটা পথ হয়তো আছে। দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হতেই সে টয়লেটে গিয়ে মিলন সামন্তকে ফোন করল।
দু-তিনটি রিং হতেই মিলন ফোন ধরল, কিন্তু কোনো সাড়া দিল না। এইসব ছেলেমানুষিই ও করে, অভিমান হলে। অভিমানের অবিশ্যি কারণ আছে, এতগুলো দিন কেটে গেছে, অনিমিখ একবারও ফোন করেনি। মিলনও যে ফোন করেনি সেটা এক্ষেত্রে গৌন হয়ে যায়। কয়েকবার হ্যালো বলার পরেও ওর সাড়া পেল না অনিমিখ। অথচ ছেলেমেয়েদের গলা পাচ্ছিল। ও নিশ্চয়ই ক্লাস নিচ্ছে।
অহং ঝেড়ে ফেলে অনিমিখ আদরের গলায় বলল, ‘কথা বলবি না ?’
‘ক্লাসে আছি।’
‘সেটা আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছি। তোকে খুব মনে পড়ছে আজ।’
‘কেন?’ মিলনের হাসির আওয়াজ এল, ‘বড়ো স্কুলের বড়ো মাস্টারের আজ এই ছোট স্কুলের মাস্টারকে মনে পড়ছে কেন? এ তো হওয়ার কথা ছিল না!’
‘এভাবে বলিস না। তুই জানিস তুমি আমার কাছে কতখানি ছিলি। সেদিনের পর থেকে আমি আর ফোন করতে পারিনি। কেমন বাধো-বাধো ঠেকছিল।’ একটু থেমে অনিমিখ সতর্ক গলায় বলল, ‘তোদের স্কুলের কাউকেই আমি তারপর আর ফোন করিনি। কারো সঙ্গেই আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘সে কি? যার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করবি বলেছিলি, তার সঙ্গেও কিছু করে উঠতে পারলি না?’
‘সে তো মাথা গরম করে বলে ফেলেছিলাম! তুই কি সত্যি ভেবেছিলি? তোর সঙ্গে মিশে আমি অনেক বদলে গেছি মিলন! আমাকে এভাবে ভাবিস না প্লিজ!’
অনেকখানি, অনেকখানি অভিনয়।
মিলনের মন গলে গেল। আরো পাঁচ মিনিট আবেগঘন কথাবার্তা চলল তাদের। তার মধ্যে অনিমিখ বুঝে ফেলল অন্বেষার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিন্ধুবিসর্গও মোরগমারি স্কুলে পৌঁছয়নি। কিন্তু চিন্তার কথা হল, অন্বেষা আজ এবং গত তিন-চারদিন স্কুলে আসেনি। হেডমাস্টারমশাইকে ফোন করে জানিয়েছে সে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছে।
তার মানে অন্বেষার খুব বড়ো বিপদ কিছু না-ও হতে পারে! তবে ওর বর ওকে আটক করেছে।
এর মধ্যে মিলনের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগেছে। এটা তাকে স্বস্তি দিল।
মিলন তাকে ভালোবাসে, সত্যিই।
আশ্চর্য ব্যাপারটা হল, মিলনের সঙ্গে কথা বলে ফোন কাটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেসেজ ঢুকল – 1:30-er por phone koro. onek kichhu bolaar aachhe. chintaa
koro naa. etaa aami. Sontoron oto sojaa noe.
এটা অন্বেষা! সন্দেহ নেই! স্কুলে থাকাকালীন অনিমিখ যে একমাত্র টিফিন পিরিয়ডেই দীর্ঘ সময় কথা বলার অবকাশ পায়, এটা ও ছাড়া কেউ জানবে না। প্রভাত চৌধুরীর এই কবিতার লাইনটিও অয়নের জানার কথা নয়। অয়ন কেন, খুব কম লোকই এই কবির হদিশ জানেন, এমনকি কবিদের মধ্যেও খুব কম জনই ওঁর
কবিতা পড়েছে।
কবিতার লাইনটা ওর মনে থেকে গিয়েছিল তাহলে! অথচ সেদিন মনে হয়েছিল ও এটা শোনেইনি!
কী করে আরো কিছু ক্লাস নিল, কীভাবে টিফিনের পিরিয়ডটি এসে গেল, অনিমিখ টের পেল না। এতখানি অস্থিরতা সে এর আগে কখনই টের পায়নি নিজের বুকে। টিফিন হতেই ছেলেমেয়েদের হইচইয়ের মধ্যে স্কুল থেকে বেরোল। আবার চলল সেই নদীটির দিকে।
ফোন করতে হবে মেসেজ যে নম্বর থেকে এসেছে সেটাতেই। এটা অন্বেষা বলে দেয়নি। কিন্তু বলার দরকারও নেই। এটা সম্ভবত অয়নের কোনো নম্বর। একটা ফোন যখন ও হাতে রাখতে পেরেছে, অয়নের থেকে খুব বড়ো বিপদের আশংকা আপাতত না করলেও চলে।
রিংটোন বেজে উঠতেই ভেসে এল অন্বেষার উৎকন্ঠাভরা পরিশীলিত গলা, ‘আমি বলছি।’
‘খবর কী?’
‘খবর খুবই খারাপ। ওই মেসেজ তুমি করেছিলে কেন? আমি তো তোমাকে বারণ করেছিলাম, আমি সংকেত না দিলে তুমি কোনোরকম যোগাযোগ করবে না!’
অনিমিখ স্তিমিত গলায় বলল, ‘সত্যিই কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। আমার আসলে খুব খারাপ লাগছিল সেদিন। মনে হচ্ছিল তুমি আমার আচরণে হয়তো কষ্ট পেয়ে থাকবে!’
‘সেটা পেলে আমি তখনই তোমাকে জানিয়ে দিতাম। লুকোতাম না।’
সেটা ঠিক। এটা হতেই পারে না, অন্বেষা জানাত না। ফোন হোক বা বিছানা, ও নিজের কোনো অপছন্দ বা অতৃপ্তি গোপন করে না। অনিমিখ সেটা জানে।
অনিমিখ বলল, ‘বোকার মতোই করে ফেলেছিলাম মেসেজটা। আমারও দোষ হয়তো নেই। প্রেমে পড়লে কেউ কি বোকা না হয়ে থাকতে পারে?’
‘প্রেম এখন মাথায় উঠেছে! ফোনটা ফিরে পেলে বাঁচি!’
‘তোমার ফোনটা কি এখন ওর হাতে?’
‘হ্যাঁ। ওর ধারণা ওরকম মেসেজ বা ফোন আবার আসবে। ওকে ডিসটার্ব করার জন্য
কিছু লোক এটা করছে ও মনে করে।’
‘ও কি তোমাকে সন্দেহ করছে?’
অন্বেষা থেমে গেল। একটু সময় নিয়ে উদাস গলায় বলল, ‘সে তো প্রথম থেকেই করে! বিয়ের পর থেকেই আমার উপর নজর রেখে আসছে। কয়েকবার লোক লাগিয়ে নজর
রেখেছে আমার উপরে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাকে সন্দেহ হয়তো করছে না।’
‘আমাকে করছে? মানে...’
‘তুমি তো চুপ করে গেছ! ও বুঝতেই পারেনি ওই নম্বর কার! ও সন্দেহ করছে ওর এক শত্রুকে। বিজনেস নিয়ে তার সঙ্গে ওর রেষারেষি চলে। ও বরং এখন আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। ওই যে তুমি স্কুলে যাওয়ার পথে আমাকে তুলে নেবে বলেছ, আমার কেউ ক্ষতি করে দেবে এই ভয়ে স্কুলে যেতে দিচ্ছে না। চাকরি ছেড়ে দিতে বলছে। জানো, ওর রিভলভারটা আমাকে দিয়ে ও বেরিয়েছে আজ। আমি তো চালাতেই জানি না! কী ভয় করছে টেবিলের উপরে ওটা দেখলে! এখনই অবিশ্যি ফিরে আসবে। মোবাইলের রিচার্জ করতে গেছে। একজনের সঙ্গে দেখাও করবে।’
নদীর উপরে কিছু কাক ওড়াউড়ি করছে। নদীতে খুব বেশি জল নেই। সম্ভবত কোনো গরুর মৃতদেহ ভেসে এসে অল্প জলে আটকে পড়ে আছে। কাকগুলো খুব চেঁচামেচি করছে।
অনিমিখ বলল, ‘তাহলে কী করা যায় এখন?’
‘কিছুই করার দরকার নেই। সময় দাও। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন তুমি কোনোভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা কোরো না। সুযোগ পেলে আমি মেসেজ করে দেবো। তখন তুমি ফোন কোরো।’
অনিমিখের খেয়াল হল, আজ অবধি অন্বেষা তাকে একবারও নিজে ফোন করেনি। মেসেজ করেছে। মিসড কল দিয়েছে। কিন্তু ফোন করেছে অনিমিখই।
এ কি কৃপণতা, নাকি কোনো কৌশল?
অনিমিখের মনে হচ্ছিল অন্বেষার অনেকখানি হদিশ সে আজও পায়নি।
সে কথা বলে লাভ নেই। পরে কখনো একান্তে এটা নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করা যাবে। অনিমিখ তার বদলে বলল, ‘ওর মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি দেখছি কী করে সেটা করা যায়।’
অন্বেষা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কী করবে তুমি? কিছু করার দরকার নেই বললাম তো!’
‘আমার উপর ছাড়ো ব্যাপারটা। ওর বুদ্ধি বুঝি তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি মনে করো?’
‘পাগলামি কোরো না অনিমিখ…’
অন্বেষাকে থামিয়ে অনিমিখ বলল, ‘ওর মেইল আইডি আর পাসওয়র্ড আমাকে দিতে পারো কোনোভাবে? আর ওর কোনো ঘনিষ্ঠ লোকের মেলের আই ডি?’ এটা সে আগেও ভেবেছে। কোনো বিপদ হলে ওগুলো ব্যবহার করে অয়নকে বিভ্রান্ত করা যেতে পারে। অন্বেষার কাছে চাইতে সাহস করেনি।
অন্বেষা শক্ত গলায় বলল, ‘ওসব আমি জানি না। আমাকে ওসব ও জানায় না। তবে জানলেও বলতাম না। ওকে আমি ভালোবাসি। তুমি ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করলে, আমি তাতে নেই।’
খুব ঠান্ডা প্রশ্ন করল অনিমিখ, ‘কাকে বেশি ভালোবাসো?’
ঝাঁঝালো উত্তর এল, ‘আমার হাতে দাঁড়িপাল্লা নেই। কিন্তু ওকে আমি তোমার চেয়ে কম ভালবাসি এটা ভেবে নিও না।’
অনিমিখ হতাশার সুর টেনে বলল, ‘এতকিছুর পরে এই কথা বললে তো ফুরিয়েই গেল!’
‘কিছুই ফুরিয়ে গেল না! তাহলে একটা কথা জানাই তোমাকে? তোমার শুনতে ভালো লাগবে না হয়তো, তবু শোনো। কাল বিছানায় চরম মুহূর্তে আরেকটু হলে আমি তোমার নাম ডেকে ফেলছিলাম! কী করে সামলে নিয়েছি জানি না, কিন্তু সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল!’
‘অন্বেষা!’
‘ও হয়তো খেয়াল করত না কিছুই। ও তখন সব ভুলে আমাকে নিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। কী যেন হয়েছিল ওর গতরাতে! অনেক দিন পর অমন মেতে গিয়েছিল!’
‘অন্বেষা!! চুপ করো!’
‘শুনে রাখো, ওর কোনো ক্ষতি তুমি করবে না। আর, আমি না মেসেজ করলে, একটাও ফোন বা মেসেজ করবে না। নিজেও কোনো অচেনা নম্বরের ফোন ধরবে না, যদি আগে সেটা থেকে আমার মেসেজ না পাও। আমাকে সত্যিই নিজের জীবনে রাখতে চাইলে, এগুলো মেনে চলো প্লিজ! এখন রাখলাম। ও এসে পড়তে পারে।’
শুধু কাকগুলোর চীৎকারই জেগে থাকল। দূর থেকে ভেসে আসছে স্কুলের কোলাহল।
অনিমিখ ফিরে চলল স্কুলের দিকে। কোলাহল বাড়তে থাকল। কাকের আওয়াজ মুছে দিল।
একটা পরিকল্পনা তার মাথায় আবছা আকার নিচ্ছিল।
স্কুলে ফেরার পর স্টাফরুমে সুশোভনবাবু নামক এক কমবয়সী শিক্ষক সকলের সামনে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘অনিমিখবাবু, আপনি মাঝেমধ্যেই টিফিনে আমাদের ছেড়ে একা একা নদীর দিকে যান কেন? পায়খানার ভালো ব্যবস্থাই তো আমাদের স্কুলে আছে!’
অনেকে হেসে উঠলেন তার কথায়। এমনকি মহিলারাও হাসতে শুরু করেছেন। কেমিস্ট্রির শিক্ষক তাপস মিত্র বললেন, ‘আরে পায়খানা নয়, উনি কবিতা ভাবতে যান নির্জনে! তাই না অনিমিখবাবু? নদীর সঙ্গে কবিদের তো চিরকালের সম্পর্ক!’
এটা পূর্বপরিকল্পিত। এবার এগুলো তাকে সহ্য করতে হবে। গোলমেলে প্রতিক্রিয়া জানালেই এঁরা বাড়াবাড়ি শুরু করতে পারেন। অনিমিখ অপমানিত বোধ করল, কিন্তু চেপে গেল। একটু জল খেল, ভেবে নিল, তারপর বাঁকা হেসে বলল, ‘কবিতা-টবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি স্যার! রোদ পোহানোর জন্য যাই ওখানে। আপনারাও চলুন না! ভালো লাগবে, দেখবেন!’
তার স্থির গলার শব্দগুলো সকলের হাসি মুছে দিতে অনিমিখ বেশ তৃপ্তি পেল। সবচেয়ে বেশি করে পেল আত্মবিশ্বাস। সেটা একেবারেই টলে গিয়েছিল।
স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই সে একটা পরিকল্পনা ছকে ফেলল।
বাড়ি ফিরেই সটান গিয়ে বসল কম্পিউটারের সামনে। বেশ কিছুদিন পরে তাদের বাড়ির মধ্যে বেজে উঠল কম্পিউটার টার্নড অন হওয়ার পরিচিত আওয়াজ। রিয়া একবার উঁকি দিয়ে গেল। আওয়াজটিই তার কারণ। অনিমিখ খুলল মাইক্রোসফট ওয়র্ড। লিখতে শুরু করল মাথার মধ্যে তৈরি করে আনা শব্দগুলো।
কবিতা নয়।
হুমকি চিঠি। বেনামি হুমকি চিঠি।
অয়নকে।
একজন অয়নকে হুমকি দিচ্ছে তার ব্যবসা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে, নাহলে সে অয়নের
বৌকে তুলে নিয়ে যাবে, ধর্ষন করবে, টুকরো-টুকরো করে কেটে বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে যাবে। এর মধ্যে অনিমিখ মিশিয়ে দিল কিছু চরম খিস্তি, সেই খিস্তিগুলো যে কোনো মানুষকে রাগে উন্মত্ত করে
তুলতে পারে।
চিঠিটা লিখে নিজের মধ্যে জেগে ওঠা তৃপ্তি তাকে অবাক করে দিল। সে যেন শান্তি পাচ্ছিল এই চিঠির মাধ্যমে অয়নকে ধর্ষণ করতে পেরে। এতটা হিংসা অয়নের প্রতি তার মধ্যে কোথা থেকে এল!
প্রিন্ট আউট নিল। খামে ভরল। অয়নের ঠিকানা লিখল। ডাকটিকিট লাগাল। জলখাবার খেল। চা খেল। সিগারেট ধরাল। মেয়েকে হামি দিয়ে খোশমেজাজে বেরিয়ে
বাড়ির কাছের পোস্টবক্সে চিঠিটা গলিয়ে দিল।
এবং পরমূহূর্তেই আফশোসে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল।
এই চিঠি তো তার শহরের বাইরে ফেলা উচিত ছিল!
গোড়ার এই গলদ তাকে চরমতম বিপদে ফেলবে না তো আবার! অয়ন তো বুঝে নিতে পারে এটা কোন ডাকঘর থেকে পোস্ট
করা হয়েছে! এবং সেখানেই অন্বেষার একজন প্রাক্তন সহকর্মীর বাড়ি। একজন চরিত্রহীন সহকর্মী, যে একসময় কিছু ছাত্রীর শ্লীলতায় হাত দিয়েছিল বলে প্রচারিত আছে।
দুইয়ে-দুইয়ে এমন চমকপ্রদ
চার করার মতো বুদ্ধিমত্তা হয়তো অয়নের নেই! তবু…
দুম করে ওই চিঠিটা সে কেন লিখল, একটুও অপেক্ষা না করে কেন পোস্ট করল, অনিমিখের নিজের
কাছেই কৈফিয়ত নেই।
নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে সে বাড়ি ফিরে এল। খুব যেন সহজ একটা রাস্তা ছিল তার বেঁচে যাওয়ার। সেটার হদিশ সে
পেতে পারত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খুঁজে পাওয়ার আগেই সেই রাস্তা নিজের হাতে বন্ধ
করে দিয়েছে।
অনিমিখের দম আটকে আসার অনুভূতি হল।