৮ম অধ্যায়




একেবারে পরের দিন সকালে স্কুল যাওয়ার আগেই ফোন অন করল অনিমিখ করা মাত্রই আরো কিছু মেসেজ একের পর এক এসে ঢুকলো তার ফোনে সবগুলোই অন্বেষার নম্বর থেকে আসছে প্রতিটিতে হিংস্র কৌতুহল, কেবল শেষেরটিতে লেখা আছে – evaabe keno lukie thaakchho tumi? keno kosto diccho amake?  
এই মেসেজগুলোর কোনোটাই অন্বেষার হতে পারে না ওর ফোন এখন ওর হাতে নেই অবশ্যই অয়ন ফোনটিকে হস্তগত করেছে মাথা খাটিয়ে বের করার চেষ্টা করছে বৌয়ের কোনো গোপন প্রেমিক আছে কিনা
এবং অয়ন অনিমিখের নম্বরটিকেই ঘোরতর সন্দেহ করেছে আশা করা যায় অনিমিখের নম্বর তার নামসমেত অন্বেষা নিজের ফোনে সেভ করেনি ওর ফোনে নিশ্চয়ই অনিমিখের কোনো চিহ্ন নেই সেটা হলে সন্দেহের জায়গা থাকত না, এই মেসেজগুলোও আসত না হয়তো অয়ন এসে উপস্থিত হত সশরীরে হাতে খোলা ছুরি নিয়ে, বা না নিয়ে
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এখন অনিমিখের নাগালে একেবারেই নেই তার কল্পনাশক্তি, তার পাপের ধারণা, এইসবের সঙ্গেই পরিস্থিতিও তার হাত ছেড়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই সেটাও করতে হবে একেবারেই শান্ত থেকে মুখ বন্ধ রেখে কিন্তু ফোনটি বন্ধ রাখা চলবে না তাহলে অন্বেষার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু, সে বুঝবে কী করে অন্বেষা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে? ওর নম্বর থেকে ফোন এলে ধরার প্রশ্নই নেই, অন্য কোনো অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলেও কি ধরা ঠিক হবে? সেটাও তো টোপ হতে পারে!
কোনো অচেনা ফোন ধরাই চলবে না একেবারেই না
হঠাৎ মাথায় একটা আরো বিশ্রী চিন্তা এল অন্বেষা বেঁচে আছে তো? অয়ন বৌকে মেরে ফেলেনি তো? লোকটার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছে সে, সেটা আদৌ অমূলক চিন্তা নয় কোনো একটা টেন্ডারের ব্যাপারে অয়ন একটা মার্ডার কেসে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে আছে, সে শুনেছে ওর হাতে কিছু পোষা গুন্ডাও নাকি আছে ঠিকাদারির ভিতরে এবং বাইরে ওর যেসব ধান্দা, সেখানে তাদের কাজে লাগায় ও হেঁটে স্কুল যাওয়ার পথে অনিমিখ টের পেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা হিমেল স্রোতটি অবাক হয়ে টের পেল, অন্বেষার মৃতদেহের বদলে সে এখন নিজের কথাই ভাবছে! অন্বেষা খুন হলে সে নিজেও তো বাঁচবে না! এমনভাবে জড়িয়ে পড়বে, খুব কাপুরুষের মতোই সে কেঁপে উঠল ভেবে, তার জীবন শেষ হয়ে যাবে রিয়ার সামনে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে সে কি আর! চাকরি যাবে পরিবার যাবে আরো ভয়ানক একটা ব্যাপার আছে
সে নিজেই এখন খুন-টুন হয়ে যেতে পারে
বেশ কয়েকবার পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে অনিমিখ স্কুলে পৌঁছলবুঝল, কবি হওয়ার লোভ ছাড়াও মধ্যবিত্ত ছাপোষার একটা গুণ তার মধ্যে ষোল আনা আছে
সেটা প্রাণের ভয়
সেটা আর সে নিজের কাছেও লুকোতে পারবে না


স্কুলে এখন তার কোনো জনপ্রিয়তা নেইমাস্টারমশাইরা তাকে ফাঁকিবাজ ভাবেনতার গা থেকে ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধে নাক কোঁচকানছাত্ররাও খুব আগ্রহী হয়তো নয় তাকে নিয়েকেউই নিজের থেকে কথা বলতে বা জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে আসে নাএই স্কুলে তার বেতন এখনও চালু হয়নিকাগজপত্রের কিছু ব্যাপার মিটলেই সেটা চালু হবেঅবিশ্যি বকেয়া বেতন একইসঙ্গে পেয়ে যাবেসেই ব্যাপার নিয়ে প্রথম পিরিয়ডটা তাকে অফিসেই কাটাতে হলএরপরে টিফিন অবধি তার টানা তিনটি ক্লাস আছেসেই ভূগোল শিক্ষক আজ আবার আসেননিভদ্রলোক নাকি অসুস্থতাঁর একটি ক্লাস তাকে আজ নিতে হবে
এর মধ্যে অনিমিখ নিজেকে বোঝাতে সচেষ্ট হল, অন্বেষা অবশ্যই খুন হয়নি! বড্ডো বেশি ভেবে ফেলছে সে! তবু কোনো গোলমাল হয়েছে কিনা, জেনে নেওয়ার একটা পথ হয়তো আছেদ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হতেই সে টয়লেটে গিয়ে মিলন সামন্তকে ফোন করল
দু-তিনটি রিং হতেই মিলন ফোন ধরল, কিন্তু কোনো সাড়া দিল নাএইসব ছেলেমানুষিই করে, অভিমান হলেঅভিমানের অবিশ্যি কারণ আছে, এতগুলো দিন কেটে গেছে, অনিমিখ একবারও ফোন করেনিমিলনও যে ফোন করেনি সেটা এক্ষেত্রে গৌন হয়ে যায়কয়েকবার হ্যালো বলার পরেও ওর সাড়া পেল না অনিমিখঅথচ ছেলেমেয়েদের গলা পাচ্ছিল নিশ্চয়ই ক্লাস নিচ্ছে
অহং ঝেড়ে ফেলে অনিমিখ আদরের গলায় বলল, ‘কথা বলবি না ?’
ক্লাসে আছি
সেটা আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছিতোকে খুব মনে পড়ছে আজ
কেন?’ মিলনের হাসির আওয়াজ এল, ‘বড়ো স্কুলের বড়ো মাস্টারের আজ এই ছোট স্কুলের মাস্টারকে মনে পড়ছে কেন? তো হওয়ার কথা ছিল না!’
এভাবে বলিস নাতুই জানিস তুমি আমার কাছে কতখানি ছিলিসেদিনের পর থেকে আমি আর ফোন করতে পারিনিকেমন বাধো-বাধো ঠেকছিলএকটু থেমে অনিমিখ সতর্ক গলায় বলল, ‘তোদের স্কুলের কাউকেই আমি তারপর আর ফোন করিনিকারো সঙ্গেই আমার কোনো যোগাযোগ নেই
সে কি? যার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করবি বলেছিলি, তার সঙ্গেও কিছু করে উঠতে পারলি না?’
সে তো মাথা গরম করে বলে ফেলেছিলাম! তুই কি সত্যি ভেবেছিলি? তোর সঙ্গে মিশে আমি অনেক বদলে গেছি মিলন! আমাকে এভাবে ভাবিস না প্লিজ!’
অনেকখানি, অনেকখানি অভিনয়
মিলনের মন গলে গেলআরো পাঁচ মিনিট আবেগঘন কথাবার্তা চলল তাদেরতার মধ্যে অনিমিখ বুঝে ফেলল অন্বেষার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিন্ধুবিসর্গও মোরগমারি স্কুলে পৌঁছয়নিকিন্তু চিন্তার কথা হল, অন্বেষা আজ এবং গত তিন-চারদিন স্কুলে আসেনিহেডমাস্টারমশাইকে ফোন করে জানিয়েছে সে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছে
তার মানে অন্বেষার খুব বড়ো বিপদ কিছু না- হতে পারে! তবে ওর বর ওকে আটক করেছে
এর মধ্যে মিলনের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগেছেএটা তাকে স্বস্তি দিল
মিলন তাকে ভালোবাসে, সত্যিই
আশ্চর্য ব্যাপারটা হল, মিলনের সঙ্গে কথা বলে ফোন কাটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেসেজ ঢুকল – 1:30-er por phone koro. onek kichhu bolaar aachhe. chintaa koro naa. etaa aami. Sontoron oto sojaa noe.
এটা অন্বেষা! সন্দেহ নেই! স্কুলে থাকাকালীন অনিমিখ যে একমাত্র টিফিন পিরিয়ডেই দীর্ঘ সময় কথা বলার অবকাশ পায়, এটা ছাড়া কেউ জানবে নাপ্রভাত চৌধুরীর এই কবিতার লাইনটিও অয়নের জানার কথা নয়অয়ন কেন, খুব কম লোকই এই কবির হদিশ জানেন, এমনকি কবিদের মধ্যেও খুব কম জনই ওঁর কবিতা পড়েছে
কবিতার লাইনটা ওর মনে থেকে গিয়েছিল তাহলে! অথচ সেদিন মনে হয়েছিল এটা শোনেইনি!


কী করে আরো কিছু ক্লাস নিল, কীভাবে টিফিনের পিরিয়ডটি এসে গেল, অনিমিখ টের পেল নাএতখানি অস্থিরতা সে এর আগে কখনই টের পায়নি নিজের বুকেটিফিন হতেই ছেলেমেয়েদের হইচইয়ের মধ্যে স্কুল থেকে বেরোলআবার চলল সেই নদীটির দিকে
ফোন করতে হবে মেসেজ যে নম্বর থেকে এসেছে সেটাতেইএটা অন্বেষা বলে দেয়নিকিন্তু বলার দরকারও নেইএটা সম্ভবত অয়নের কোনো নম্বরএকটা ফোন যখন হাতে রাখতে পেরেছে, অয়নের থেকে খুব বড়ো বিপদের আশংকা আপাতত না করলেও চলে
রিংটোন বেজে উঠতেই ভেসে এল অন্বেষার উৎকন্ঠাভরা পরিশীলিত গলা, ‘আমি বলছি
খবর কী?’
খবর খুবই খারাপওই মেসেজ তুমি করেছিলে কেন? আমি তো তোমাকে বারণ করেছিলাম, আমি সংকেত না দিলে তুমি কোনোরকম যোগাযোগ করবে না!’
অনিমিখ স্তিমিত গলায় বলল, ‘সত্যিই কাঁচা কাজ হয়ে গেছেআমার আসলে খুব খারাপ লাগছিল সেদিন মনে হচ্ছিল তুমি আমার আচরণে হয়তো কষ্ট পেয়ে থাকবে!’
সেটা পেলে আমি তখনই তোমাকে জানিয়ে দিতামলুকোতাম না
সেটা ঠিকএটা হতেই পারে না, অন্বেষা জানাত নাফোন হোক বা বিছানা, ও নিজের কোনো অপছন্দ বা অতৃপ্তি গোপন করে নাঅনিমিখ সেটা জানে
অনিমিখ বলল, ‘বোকার মতোই করে ফেলেছিলাম মেসেজটাআমারও দোষ হয়তো নেই। প্রেমে পড়লে কেউ কি বোকা না হয়ে থাকতে পারে?’
প্রেম এখন মাথায় উঠেছে! ফোনটা ফিরে পেলে বাঁচি!’
তোমার ফোনটা কি এখন ওর হাতে?’
হ্যাঁওর ধারণা ওরকম মেসেজ বা ফোন আবার আসবে ওকে ডিসটার্ব করার জন্য কিছু লোক এটা করছে ও মনে করে।
কি তোমাকে সন্দেহ করছে?’
অন্বেষা থেমে গেলএকটু সময় নিয়ে উদাস গলায় বলল, ‘সে তো প্রথম থেকেই করে! বিয়ের পর থেকেই আমার উপর নজর রেখে আসছে কয়েকবার লোক লাগিয়ে নজর রেখেছে আমার উপরে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাকে সন্দেহ হয়তো করছে না
আমাকে করছে? মানে...
তুমি তো চুপ করে গেছ! বুঝতেই পারেনি ওই নম্বর কার! সন্দেহ করছে ওর এক শত্রুকেবিজনেস নিয়ে তার সঙ্গে ওর রেষারেষি চলে বরং এখন আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিতওই যে তুমি স্কুলে যাওয়ার পথে আমাকে তুলে নেবে বলেছ, আমার কেউ ক্ষতি করে দেবে এই ভয়ে স্কুলে যেতে দিচ্ছে নাচাকরি ছেড়ে দিতে বলছেজানো, ওর রিভলভারটা আমাকে দিয়ে বেরিয়েছে আজআমি তো চালাতেই জানি না! কী ভয় করছে টেবিলের উপরে ওটা দেখলে! এখনই অবিশ্যি ফিরে আসবেমোবাইলের রিচার্জ করতে গেছেএকজনের সঙ্গে দেখাও করবে
নদীর উপরে কিছু কাক ওড়াউড়ি করছেনদীতে খুব বেশি জল নেইসম্ভবত কোনো গরুর মৃতদেহ ভেসে এসে অল্প জলে আটকে পড়ে আছেকাকগুলো খুব চেঁচামেচি করছে
অনিমিখ বলল, ‘তাহলে কী করা যায় এখন?’
কিছুই করার দরকার নেইসময় দাওসময়ে সব ঠিক হয়ে যাবেএখন তুমি কোনোভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা কোরো নাসুযোগ পেলে আমি মেসেজ করে দেবোতখন তুমি ফোন কোরো
অনিমিখের খেয়াল হল, আজ অবধি অন্বেষা তাকে একবারও নিজে ফোন করেনিমেসেজ করেছেমিসড কল দিয়েছেকিন্তু ফোন করেছে অনিমিখই
কি কৃপণতা, নাকি কোনো কৌশল?
অনিমিখের মনে হচ্ছিল অন্বেষার অনেকখানি হদিশ সে আজও পায়নি
সে কথা বলে লাভ নেইপরে কখনো একান্তে এটা নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করা যাবেঅনিমিখ তার বদলে বলল, ‘ওর মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যেতে হবেআমি দেখছি কী করে সেটা করা যায়
অন্বেষা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কী করবে তুমি? কিছু করার দরকার নেই বললাম তো!’
আমার উপর ছাড়ো ব্যাপারটাওর বুদ্ধি বুঝি তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি মনে করো?’
পাগলামি কোরো না অনিমিখ…’
অন্বেষাকে থামিয়ে অনিমিখ বলল, ‘ওর মেইল আইডি আর পাসওয়র্ড আমাকে দিতে পারো কোনোভাবে? আর ওর কোনো ঘনিষ্ঠ লোকের মেলের আই ডি?’ এটা সে আগেও ভেবেছেকোনো বিপদ হলে ওগুলো ব্যবহার করে অয়নকে বিভ্রান্ত করা যেতে পারেঅন্বেষার কাছে চাইতে সাহস করেনি
অন্বেষা শক্ত গলায় বলল, ‘ওসব আমি জানি নাআমাকে ওসব জানায় নাতবে জানলেও বলতাম নাওকে আমি ভালোবাসিতুমি ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করলে, আমি তাতে নেই
খুব ঠান্ডা প্রশ্ন করল অনিমিখ, ‘কাকে বেশি ভালোবাসো?’
ঝাঁঝালো উত্তর এল, ‘আমার হাতে দাঁড়িপাল্লা নেইকিন্তু ওকে আমি তোমার চেয়ে কম ভালবাসি এটা ভেবে নিও না
অনিমিখ হতাশার সুর টেনে বলল, ‘এতকিছুর পরে এই কথা বললে তো ফুরিয়েই গেল!’
কিছুই ফুরিয়ে গেল না! তাহলে একটা কথা জানাই তোমাকে? তোমার শুনতে ভালো লাগবে না হয়তো, তবু শোনোকাল বিছানায় চরম মুহূর্তে আরেকটু হলে আমি তোমার নাম ডেকে ফেলছিলাম! কী করে সামলে নিয়েছি জানি না, কিন্তু সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল!’
অন্বেষা!’
হয়তো খেয়াল করত না কিছুই তখন সব ভুলে আমাকে নিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলকী যেন হয়েছিল ওর গতরাতে! অনেক দিন পর অমন মেতে গিয়েছিল!’
অন্বেষা!! চুপ করো!’
শুনে রাখো, ওর কোনো ক্ষতি তুমি করবে নাআর, আমি না মেসেজ করলে, একটাও ফোন বা মেসেজ করবে নানিজেও কোনো অচেনা নম্বরের ফোন ধরবে না, যদি আগে সেটা থেকে আমার মেসেজ না পাও  আমাকে সত্যিই নিজের জীবনে রাখতে চাইলে, এগুলো মেনে চলো প্লিজ! এখন রাখলাম এসে পড়তে পারে
শুধু কাকগুলোর চীৎকারই জেগে থাকলদূর থেকে ভেসে আসছে স্কুলের কোলাহল
অনিমিখ ফিরে চলল স্কুলের দিকেকোলাহল বাড়তে থাকলকাকের আওয়াজ মুছে দিল

একটা পরিকল্পনা তার মাথায় আবছা আকার নিচ্ছিল

স্কুলে ফেরার পর স্টাফরুমে সুশোভনবাবু নামক এক কমবয়সী শিক্ষক সকলের সামনে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘অনিমিখবাবু, আপনি মাঝেমধ্যেই টিফিনে আমাদের ছেড়ে একা একা নদীর দিকে যান কেন? পায়খানার ভালো ব্যবস্থাই তো আমাদের স্কুলে আছে!’
অনেকে হেসে উঠলেন তার কথায়এমনকি মহিলারাও হাসতে শুরু করেছেনকেমিস্ট্রির শিক্ষক তাপস মিত্র বললেন, ‘আরে পায়খানা নয়, উনি কবিতা ভাবতে যান নির্জনে! তাই না অনিমিখবাবু? নদীর সঙ্গে কবিদের তো চিরকালের সম্পর্ক!’
এটা পূর্বপরিকল্পিতএবার এগুলো তাকে সহ্য করতে হবেগোলমেলে প্রতিক্রিয়া জানালেই এঁরা বাড়াবাড়ি শুরু করতে পারেনঅনিমিখ অপমানিত বোধ করল, কিন্তু চেপে গেলএকটু জল খেল, ভেবে নিল, তারপর বাঁকা হেসে বলল, ‘কবিতা-টবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি স্যার! রোদ পোহানোর জন্য যাই ওখানেআপনারাও চলুন না! ভালো লাগবে, দেখবেন!’
তার স্থির গলার শব্দগুলো সকলের হাসি মুছে দিতে অনিমিখ বেশ তৃপ্তি পেলসবচেয়ে বেশি করে পেল আত্মবিশ্বাসসেটা একেবারেই টলে গিয়েছিল

স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই সে একটা পরিকল্পনা ছকে ফেলল

বাড়ি ফিরেই সটান গিয়ে বসল কম্পিউটারের সামনেবেশ কিছুদিন পরে তাদের বাড়ির মধ্যে বেজে উঠল কম্পিউটার টার্নড অন হওয়ার পরিচিত আওয়াজরিয়া একবার উঁকি দিয়ে গেলআওয়াজটিই তার কারণঅনিমিখ খুলল মাইক্রোসফট ওয়র্ডলিখতে শুরু করল মাথার মধ্যে তৈরি করে আনা শব্দগুলো
কবিতা নয়
হুমকি চিঠিবেনামি হুমকি চিঠি
অয়নকে
একজন অয়নকে হুমকি দিচ্ছে তার ব্যবসা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে, নাহলে সে অয়নের বৌকে তুলে নিয়ে যাবে, ধর্ষন করবে, টুকরো-টুকরো করে কেটে বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে যাবে এর মধ্যে অনিমিখ মিশিয়ে দিল কিছু চরম খিস্তি, সেই খিস্তিগুলো যে কোনো মানুষকে রাগে উন্মত্ত করে তুলতে পারে
চিঠিটা লিখে নিজের মধ্যে জেগে ওঠা তৃপ্তি তাকে অবাক করে দিল সে যেন শান্তি পাচ্ছিল এই চিঠির মাধ্যমে অয়নকে ধর্ষণ করতে পেরে এতটা হিংসা অয়নের প্রতি তার মধ্যে কোথা থেকে এল!
প্রিন্ট আউট নিল খামে ভরল অয়নের ঠিকানা লিখল ডাকটিকিট লাগাল। জলখাবার খেল চা খেল সিগারেট ধরালমেয়েকে হামি দিয়ে খোশমেজাজে বেরিয়ে বাড়ির কাছের পোস্টবক্সে চিঠিটা গলিয়ে দিল


এবং পরমূহূর্তেই আফশোসে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল
এই চিঠি তো তার শহরের বাইরে ফেলা উচিত ছিল!
গোড়ার এই গলদ তাকে চরমতম বিপদে ফেলবে না তো আবার! অয়ন তো বুঝে নিতে পারে এটা কোন ডাকঘর থেকে পোস্ট করা হয়েছে! এবং সেখানেই অন্বেষার একজন প্রাক্তন সহকর্মীর বাড়ি একজন চরিত্রহীন সহকর্মী, যে একসময় কিছু ছাত্রীর শ্লীলতায় হাত দিয়েছিল বলে প্রচারিত আছে
দুইয়ে-দুইয়ে এমন চমকপ্রদ চার করার মতো বুদ্ধিমত্তা হয়তো অয়নের নেই! তবু
দুম করে ওই চিঠিটা সে কেন লিখল, একটুও অপেক্ষা না করে কেন পোস্ট করল, অনিমিখের নিজের কাছেই কৈফিয়ত নেই


নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে সে বাড়ি ফিরে এল খুব যেন সহজ একটা রাস্তা ছিল তার বেঁচে যাওয়ার। সেটার হদিশ সে পেতে পারত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খুঁজে পাওয়ার আগেই সেই রাস্তা নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছে।
অনিমিখের দম আটকে আসার অনুভূতি হল।