১১শ অধ্যায়



বিষ্ণুপুর থেকে বাড়ি ফিরে আসার বাসে উঠেই অনিমিখের মাথায় দুটো লাইন এসেছিল, মোবাইলে লিখে নিজের নম্বরে সে মেসেজ করে দিয়েছিল, ভয় হচ্ছিল হারিয়ে ফেলতে পারে-
                        মরীচিকা কি একা দেখতে হয়?
                        একলাই ফিরিয়ে দিতে হয়?
        অনেক দিন পরে একটা কবিতা তার কাছে আসতে চাইল। খুব শক্তিশালী নয় এই দুটো লাইন, চমক কম, এমনকি বেশ সেকেলে, কিন্তু তার মনে হয়েছিল সৎভাবে এখান থেকে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা সে করবে। কেউ ছাপুক না ছাপুক, কবিতাটা সে লিখবে। এবার একমাত্র ওইভাবেই সে কবিতা লেখার কথা ভাবতে পারে। শুধু নিজের হয়ে নিজের জন্য লেখা কবিতাসম্পাদকদের মনের মতো না-ই বা হল! কোনো পত্রিকা যদি না নেয়, সে বরং ফেসবুকে দিয়ে দেবে। অনেক নবীন কবি আজকাল তো শুধু ফেসবুকেই লেখেন। কিছু নাম করা কবিও তাঁদের প্রকাশিত লেখা ওখানে নিয়মিত দেন। অনেকেই পড়েন সেসব কবিতা। মন্তব্য করেন।  
তারপরে অবিশ্যি প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কবিতাটা তার আর লেখা হয়নি। মোবাইল খুলে মাঝেমধ্যে লাইনদুটো দেখেছে অনিমিখখুব সাদামাটা হয়তো, কিন্তু এত সাবলীলভাবে না চাইতেই তার কাছে কবিতা এর আগে আসেনি। এই লাইনদুটো তার কাছে একটা গতি দাবি করছে হয়তো এটা তার জীবনের প্রথম কবিতা যেটার প্রতি তার একটা দায় আছে।

কিন্তু কবিতাটা লিখে ওঠা হয়নি। পরের কিছু লাইন প্রায়ই ঝিলিক দিয়েছে মাথায়। মিলিয়েও গেছে।


এর মধ্যে ঘরে-বাইরে তার অবস্থাটা খুব সুবিধের নয়। সকলেই এখন তার দিকে আড় চোখে তাকায়। হেডমাস্টার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন নিরঞ্জন মাহাতো। কিছু না জানিয়ে তার এইভাবে কয়েকদিনের ডুব দেওয়াটা ওঁরা সহজে ছাড়বেন বলে মনে হয় না। হয়তো ম্যানেজিং কমিটির কাছেও ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। অনেক তিরস্কার তাকে করা হল। সে চুপচাপ শুনল। নিজের অন্যায় চুপচাপ মেনে নেওয়ার মধ্যে যে একটা আনন্দ আছে, সেটা সে এই সময়ে টের পেল। এটাও খানিকটা হয়তো কমলকুমার মজুমদারের হাঁপানি সহ্য করারই মতো! মজার ব্যাপার হল, নিরঞ্জনবাবু যখন তাকে মিঠেকড়া কথাগুলো শোনাচ্ছেন, তার মাথায় বিনা নোটিশেই এসে গেল পরের দুটি স্থায়ী পংক্তি–
                দ্বিধা-থরোথরো চকোলেটের স্বাদে
এই তো তোমার বিজন ঠোঁট দেখছি
        সুধীন্দ্রনাথ দত্তর একটা প্রভাব হয়তো এসে পড়েছে। কিন্তু বেশ লাগল তার নিজের লাইনদুটো। এদের সে রেখে দেবে। এখানে এই ‘তুমি’-টা কে? অন্বেষা, না রিয়া? এটা সে নিজেই স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিল না। অন্বেষার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা কি এখানে এসে পড়েছে? নাকি, রিয়া? হঠাৎ তার মনে হল, তার কল্পনাশক্তি কখন যেন দিগন্ত থেকে পিছিয়ে এসে তার হাত ধরতে চাইছে, এখন আর কোনো রেস করার দুষ্টুমি তার নেই।
এই সব চিন্তায় বিভোর হয়ে যাওয়ার ফলেই হেডমাস্টারের ঘরে আর কোনো কটূ কথা তার কানে ঢুকল না। এতে সুরাহাই হল। তার চুপ করে থাকায় ওঁরা কিছুটা হলেও খুশি হলেন, ভাবলেন সে এবার সুবোধ গোপাল হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
স্টাফরুমে তার একঘরে অবস্থাটা কাটানোর জন্য সে একটা কায়দা নিল। একদিন টিফিনে সকলে যখন সেখানে হাজির, ঘরটি যখন সরগরম, সে উঠে দাঁড়াল, এবং জানাল তার কিছু বলার আছে। সকলে উৎসুক হলেন। তাপস মিত্র ঠাট্টা করলেন, ‘কী কথা? স্যার কি আবার বিয়ে-টিয়ে করছেন নাকি? বিশ্বাস তো নেই মশাই কবিদের!’
সকলে হাসলেন। অনিমিখও হাসল। হেসেই বলল, ‘এই বিশ্বাসের ব্যাপারটা নিয়েই কিছু বলতে চাই। বলতে চাই, স্কুলের বাইরেও আমার একটা জীবন আছে, এই স্কুলে আসার পরে সেই জীবন আমাকে একটু ব্যস্ত রেখেছিল। আপনাদের সঙ্গে মেলামেশা করার অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারিনি। আমি কবিতাচর্চা করি। ঠিক আছে। কিন্তু সেটার জন্য আমার কোনো অহমিকা নেই। দয়া করে ভুল বুঝবেন না, দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আমাকে আপনাদের একজন হিসেবেই জায়গা দিন প্লিজ!’
তার এই অণু-বক্তৃতা ম্যাজিকের কাজ করলএকটা মৃদু হাততালির ঝড় উঠল স্টাফরুমে। অনেকেই এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বয়স্ক শক্তিবাবু সকলের হয়ে বললেন, ‘তুমি আমাদেরই একজন বাবা। আমরা কখনও তোমাকে অন্য কিছু ভাবিনি। আমরা জানি, ব্যক্তিগত কারণে মানুষ অনেক সময় অন্যদের সময় দিতে পারে না।’
এমনকি নিরঞ্জনবাবুও তাঁর কাজ ফেলে একবার উঁকি দিয়ে গেলেন। মজাদার ঘটনাটা শুনে খুশিই হলেন। অস্ফূটে বললেন, ‘তবু ভালো!’
এরপর থেকে স্কুলে তার পরিস্থিতিটা অনেকে সহজ হয়ে গেছে। এখন শুধু দেখার ম্যানেজিং কমিটি তার ওই না বলে কয়ে ছুটি নেওয়ার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়!
ওই বক্তৃতায় অভিনয় তো ছিলই, কিন্তু, অনিমিখ খুব ভিতর থেকে জানে, অনেকটা আবেগও না চাইতেই মিশে ছিল।
কিন্তু, আশা করা যায় চাকরি নিয়ে ফাঁড়াটা সে কাটিয়ে দিতে পেরেছে।
আর তারমধ্যেই মিলে গেছে পরের দুটি লাইন
                        এমনি কোন প্যাকেট থেকে বেরিয়ে
                        শূন্যতা আজ শূন্যে ভেসে গেল
অবিশ্যি এই লাইনদুটোও লেখার অপেক্ষায় আছেকবিতাটা লিখতে বসাই হয়নি। তবে একটা ব্যাপার ঘটল, এই প্রথম সে স্কুলে থাকাকালীন কোনো কবিতার অংশ পেল। এর আগে এটা হয়নি।

বাড়িতে অবিশ্যি কোনো বক্তৃতাতে আর কাজ হবে বলে মনে হয় না। একমাত্র সোনু ছাড়া কেউ তার সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলছে না। তার ওই কয়েকদিনের অনুপস্থিতির মধ্যে মায়ের শরীর বেশ খারাপের দিকে গিয়েছিল। জ্যোতির্ময় হালদার সেটা সামলেছেন। এখন তার ফলে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
অনিমিখ তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে মা আর বৌয়ের সঙ্গে সহজ হওয়ার। কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। মা আজকাল আর দোতলা থেকে নামেই না। সোনু আর রিয়া ছাড়া কেউ ঢোকেও না তার ঘরে। একদিন অনিমিখ দরজায় টোকা দিতে মায়ের উত্তর এল সে ঘুমোতে চায়, কেউ যেন বিরক্ত না করেমা এখন পুরোপুরি রিয়ার দখলে। রিয়া যেন তার বৌমা নয়, এখন মেয়ে হয়ে উঠেছে! অনিমিখ যেন ছেলের বদলে জামাই হয়ে গেছে!
একবার অনিমিখ মরিয়া হয়ে রিয়ার স্নান করার সময় বাথরুমে ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছিল। পিছল রিয়া তার হাত থেকে বেরিয়ে নগ্ন অবস্থাতেই শোবার ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছেতারপর থেকে রিয়া বাথরুমে ছিটকিনি দিয়ে স্নান করে। অথচ তাদের অনেক স্মরণীয় সঙ্গম বাথরুমেই শুরু হয়েছিল। বাথরুম অনেক নোংরা চাহিদাকে প্রশ্রয় দেয়, শোবার ঘর সেগুলোকে সহ্য করে না।
রাতে বিছানায় দুজনের মধ্যে একটা বিরাট পাশবালিশ রাখা থাকে এখনঅনিমিখ সেটা সরানোর সাহস আর করেনি। পাশ ফিরে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছে।
অনেক বছর ধরে গড়ে তোলা প্রায় শতাধিক ব্লু-ফিল্মের ভান্ডারটিকে সে এখন নদীর জলে বিসর্জন দিয়েছে। নদীতে জল অবিশ্যি বেশি নেই। বালিতেই ভর্তি। হয়তো কেউ নদী থেকে কুড়িয়ে পাবে সেগুলো!
অনিমিখ এখন শুধু আপ্রাণ চাইছে নিজের বৌয়ের সঙ্গে একটি সবল, সুস্থ, এবং দীর্ঘস্থায়ী মৈথুন। কিন্তু সেই সুযোগটাই নেই।
ওই বালিশ এভারেস্টের চেয়েও উঁচু!
বরফ পুরোপুরি না গললে ওটা সরবে না!
রোদ ওঠার কোনো সম্ভাবনাই আপাতত দেখা যাচ্ছে না! আপাতত শুধু প্রায়শ্চিত্তের বিচিত্র ধারণাটা নিয়েই মেতে থাকা যায়। এও বেশ মজাদার খেলা। পাওলো কোহেলো জানতে পারলে হয়তো এখনই অনিমিখের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।

অন্বেষার মেসেজ নিয়ম মতোই আসছে। প্রতি রাতেই এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে ওর একটা মেসেজ ঢোকে – sob thik aachhe. good night. অর্থাৎ, অন্বেষা এখনও মনে করে অনিমিখ তার বরের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দিন কাটাচ্ছে। ঘটনা হল, অনিমিখ ওই ব্যাপারটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছে। নামিয়ে রাখতে পেরেছে বুকের ভারি পাথরটাকে।
অনিমিখের মন সত্যিই অনেক বদলে গেছে। সে ঠিক করেছে অন্বেষাকে মুছে ফেলবে। মুছে ফেলতেই হবে। এবং সেটা ওকে জানিয়েই করতে চায় সে। এমন নয় অন্বেষার শরীর তাকে আর হাতছানি দেয় না। প্রায়ই শেষ রাতে ঘুমে ভেঙে যায় যৌন উত্তেজনায়। রিয়া তখন পাশবালিশের ওপাশে। সে ছটফট করে। অন্বেষার শরীরের প্রতিটি বাঁক তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। হাতে লেগে যায় মেয়েটার শরীরের ছোঁয়া। সঙ্গমের সময় ওর গলা চিরে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শীৎকার তার কানে বাজতে থাকে। শরীর অসম্ভব গরম হয়ে ওঠে। অনিমিখ প্রাণপনে তখন ভাবতে থাকে ছিন্নমস্তা মন্দিরের সেই মূর্তিটিকে। তার ভাবনাগুলোকে এবং প্রতিশ্রুতিটিকে মনে টেনে আনে আবার। আশ্চর্য কাজ হয় তাতে। সে টের পায় তার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
এখন এই সিমকার্ডটিকে ফেলে দিলেই অন্বেষা অবিশ্যি তার হদিশ আর পাবে না। কিন্তু ওভাবে পালাতে সে চায় না। সব কথা বলতে চায় সে। এই সম্পর্কে তার আর সুখ নেই, অসুখ বেড়ে চলেছে। সে মুক্তি চায়। সবকিছুর দায় স্বীকার করেই মুক্তি চায়।
এটুকু ডিগনিটি ছাড়া তার মনে হয় একটা পরকীয়া শেষ করা চলে না।
একটা সংলাপ সে চাইছে অন্বেষার সঙ্গে।
কিন্তু অন্বেষা যতক্ষণ না তাকে ফোন করতে বলে, সেটা সম্ভব নয়।


আপাতত ওই লাইনগুলোকে মাথায় নিয়েই অনিমিখ তার অদ্ভুত দিনগুলো কাটাচ্ছে। বাজারে যাচ্ছে। স্কুলে সকলের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করছে। বিকেলে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। বইপত্র পড়ছে। লাইনগুলো এর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে আর লিখে রাখার দরকার নেই ওদের। এমনিতেই মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মেল চেক করে দেখেছে কিছু পত্রিকা তার থেকে লেখা চেয়েছে। হাতে লেখা নেই। এই কবিতাটা যতদিন না লিখে উঠতে পারছে, অন্য লেখায় হাত দেওয়ার ইচ্ছে নেই অনিমিখের। চাইলে এখনই এটাকে শেষ করে দেওয়া যায়, ১০ বছর অগণিত ছাপার যোগ্য কবিতা লেখার পরে সেটা কঠিন কিছুই নয়। কিন্তু অনিমিখ সেটা চাইছে না। যেমন প্রথম লাইন দুটো এসেছিল, যেমন পরের লাইনগুলো এসেছে, সে চায় কবিতাটা তেমনই শেষ হোক, নিজের লাইনগুলো নিজেই খুঁজে নিক।
রিয়ার সঙ্গে একটা দুর্দান্ত মৈথুন হয়তো সেই লাইনগুলো তাকে দিতে পারে, কিংবা যদি একবার মায়ের সঙ্গে সারাদিন বসে ছেলেবেলার অনেক গল্প করা যায়। হয়তো অন্বেষার সঙ্গে একটা ফয়সালায় পৌঁছতে পারলেই সে শেষ লাইনগুলো পেয়ে যাবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
একটা কবিতা নিয়ে এতদিন কাটানোর অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। সে কি সত্যিই কবি হয়ে গেল নাকি!

অবশেষে অন্বেষার সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা এল। মেসেজ এল অনিমিখ আবার দুপুর দেড়টার পরে ফোন করতে পারে, আর কোনো ভয় নেই। অন্বেষা হয়তো ভেবেছে এই সংক্ষিপ্ত মেসেজ অনিমিখকে এক পৃথিবী আনন্দ দেবে, হয়তো ক্লাস করতে করতেই অনিমিখ নেচে উঠবে একপাক, এখনই চলে আসতে চাইবে তার বাড়িতে... বিছানায়
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই সেটা হতে পারত। তখন প্রতি মুহূর্তে অনিমিখ অন্বেষার শরীরের জন্য পিপাসিত ছিল, অধীর ছিল। আজও সেই শরীর তাকে জ্বালায় না এমন নয়, কিন্তু সেই জ্বলুনিকেই সে এখন সঙ্গী করে নিতে শিখেছে। এমনকি তা তাকে বেশ সুখই দেয় আজকাল। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার সুখ।
অনিমিখ খুব ছোট করে উত্তর দিল – dekhchhi
তারপর মনে হল সে নিজের দাম অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলল। অন্বেষা এই উত্তরে চটবে না? চটে যেতেই পারে! কিন্তু কী যায় আসে আর!

এর চেয়ে অনেক বড়ো বিস্ফোরণ অপেক্ষায় আছে।

অনিমিখ আজই শেষ কথা বলতে চায় অন্বেষার সঙ্গে

আবার সেই নদী। কমে আসা শীতে তার জল আরো শুকিয়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি দেখা যাচ্ছে। সেই বালির উপরে অনেক আবর্জনার চিহ্ন চোখে পড়ছে। পিকনিক করেছে অনেকে ওখানেই। নদীটা এরকমই থাকবে বর্ষাকাল পর্যন্ত। বিশ্বাস করা যাবে না সে এক জ্বলজ্যান্ত নদী। তারপরে ধীরে ধীরে আবার ফুলে উঠবে। ফেঁপে উঠবেবন্যা ডেকে আনবে। এই নদীকে তখন চেনা যাবে না। আশপাশের গ্রামগুলোকে ডুবিয়ে দেবে। বাস-চলাচল বন্ধ হয়ে যাবেবন্যাত্রাণের নৌকোগুলো সশব্দে ঢেউ তুলে ছোটাছুটি করবে। মাথার উপর চক্কর দেবে হেলিকপ্টার। শহরের সকলে ভয়ে ভয়ে আলোচনা করবে বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনার কথা।
কিংবা, এখনই নদীটাকে চেনা যাচ্ছে না। ওই বন্যাই হয়তো তার আসল রূপ।
        অন্বেষাকে অনেক কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়ে সে এসেছে। নম্বরটা লাগানোর আগে একটা সিগারেট সে ধরিয়ে নিল। আজকাল সে লক্ষ্য করেছে টিফিনের সময়ে এইদিকে আর কোনো ছাত্রছাত্রী আসে না। ওরা জানে এখানে অনিমিখবাবু ঘোরাঘুরি করেন।
        অন্বেষার উৎসুক এবং হাসিখুশি গলা ভেসে আসতেই অনিমিখের হিসেব ওলট-পালট হয়ে গেল। সে কিছু বলতেই পারল না প্রথমে
        অন্বেষা বলল, ‘কী হল? কিছু বলছ না কেন? রাগ করেছ?’
        অনিমিখ শুকনো গলায় বলল, ‘না তো! রাগ করব কেন?’
        ‘রাগ করেছ আমি জানিকিন্তু আমি যেটা করেছি, সেটাই একমাত্র রাস্তা ছিল। কোনোরকম যোগাযোগ বিপজ্জনক ছিল। ওকে বিশ্বাস নেই। তবু তো আমি থাকতে পারিনি, রোজ একটা হলেও মেসেজ তোমাকে করেছি। রাত্তিরে টয়লেটে গিয়ে মেসেজটা করতাম। তুমি বুঝতে পারবে না, কী ভয় তখন করত!’
        অনিমিখের জিজ্ঞাসা করা কি উচিত এখন, মেসেজটা অন্বেষা অয়নের সঙ্গে সেক্স করার আগে করত, নাকি মেসেজটা সেরে, বাকি প্রাকৃতিক কর্ম সেরে হাল্কা মন ও শরীর নিয়ে অয়নের বিছানায় উঠত? সেই বিছানা, যার মাপ এবং আরামের স্বাদ অনিমিখও জানে। হয়তো আরো অনেকে জানে!
এইসব চিন্তা মাথায় এনে অনিমিখ অন্বেষাকে একটু ঘৃণা করার চেষ্টা করলনিজের উত্তেজনার রাস্তা বন্ধ করতে চাইল। কিন্তু তাকে বলতেই হল, ‘আমি বুঝি সেটা। কিন্তু ওই মেসেজ না পেলে আমি উদ্বেগেই শেষ হয়ে যেতাম।’
কীসের উদ্বেগ? তার নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য উদ্বেগ। কিন্তু বলেই বুঝল, এটাকে অন্বেষা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করবে।
অন্বেষা বলল, ‘জানিও আমাকে পেটাত বা মেরে ফেলত বলে মনে হয় না। তবে খুব সাঙ্ঘাতিক কোনো স্টেপ তো নিতই। কেন যে তুমি করতে গেলে ওটা!’
অনিমিখ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বোকার মরণ!’
‘তুমি সত্যিই বোকা। এই, আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলে কী করে গো এতদিন? আমি তো মরে যাচ্ছিলাম, জানো!’
অন্বেষার শিক্ষিত ইরোটিক গলা তার সুরক্ষার দেওয়ালকে ভেঙে দিতে চাইছেঅনিমিখ বিপদ সংকেত পেল। সে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে, এই ভয়ে বলল, ‘মানুষ সব পারে অন্বেষা।’
আবার অত্যন্ত উসকানিমূলক সুরে অন্বেষা বলল, ‘তুমি যে পারো, সেটা দেখলাম! কিন্তু আমি পারি না জানো! আমি আর পারছি না থাকতে! তুমি আমাকে এক্কেবারে শেষ করে দিয়েছ! কী করে যে এই এতগুলো দিন কাটালাম, আমিই জানি!’
একটু আঘাত করার ইচ্ছেতেই অনিমিখ বলল, ‘কেন! অয়ন তো ছিল!’
‘বাজে বোকো না। এই, একটা খবর আছে!’
‘কী?’
‘ও আগামীকাল দুপুর থেকে রাত্তির অবধি থাকবে না। এমনকি আগামীকাল রাতে বাড়ি ফিরতে না-ও পারে। আমি ছুটি নেব। কিছু একটা বলে দেব স্কুলে, আর ওকেওমাথা ধরা বা অন্য কিছু। তুমি দুপুর দুটো নাগাদ সোজা বাড়িতে চলে এসো।’
‘কিন্তু...’
‘কোনো কথা নয় খোকাবাবুকোনো অভিমান নয়। আগামীকাল তুমি আসছ। কোনো ভয় নেই। ভয় থাকলে আমি ডাকতামই না তোমাকে, এটা তো জানো!’
‘আরে...’
‘এখন রাখলাম। সামনাসামনি কথা হবে। অনেকরকম শোধ তোলার আছে। হি হি হি হি...’
ফোন কেটে যাওয়ার পরে সত্যিই বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অনিমিখ।
কী হল এটা!
অবিশ্যি এখনই সে আরেকটা ফোন করতে পারে, সবকিছু খোলাখুলি বলতে পারেকিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? আর কি সেটা করা চলে? সেটা হলে অন্বেষা তাকে কাপুরুষই ভাববে। ভাববে বাড়ি যেতে সে ভয় পাচ্ছে। সম্পর্কটা থেকে পালাচ্ছে।
ভয় সে পাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে। পালাতে চাইছে। কিন্তু হেরে যাওয়া থেকে। নিজের কাছে।
আজ সে নিজের উত্তেজনা ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আগামীকাল? অন্বেষা যখন তার রক্তমাংস নিয়ে সামনে আসবে? আগামীকালই ও এতগুলো  দিনের তেষ্টার শোধ তুলবে, নিজেই তো বলল!
পারবে সামলাতে অনিমিখ?

খুবই বিরক্তির সঙ্গে সে সিগারেটের শেষটা ছুঁড়ে দিল নদীর দিকে।
আর ঠিক তখনই কথা নেই বার্তা নেই সে তার কবিতার শেষ লাইনগুলো পেয়ে গেল –
                        আর কেউ নেই
                        সুন্দরও নেই
হাসপাতাল পালিয়ে যাচ্ছে বনবিভাগ ভেঙে

তার মানে এই কবিতাটা এতদিন সে অন্বেষাকে নিয়েই লিখছিল!!!!