৯ম অধ্যায়



এর পরের দুদিন খুবই অস্থিরতার মধ্যে কাটল অনিমিখেররাতের ঘুম চলে গেল ওই চিঠি তাকে বাঁচানোর চেয়ে ঢের বেশি করে ফাঁসানোর ক্ষমতা রাখে আরো সময় না নেওয়ার জন্য নিজেকে দোষারোপ করছিল কী হয়েছে তার ব্রেনের! কবিতা লিখতে পারছে না, সেটা তার নিজের সিদ্ধান্ত চাইলে ছাপার যোগ্য একটা কবিতা সে এখনই লিখে ফেলতে পারে কল্পনার সঙ্গে একটু লুকোচুরি খেলার পরেই হয়তো তার কবিতায় সত্যিকারের আলো পড়বে এখন কবিতা ছাপতে দেওয়ার তাগিদটাই নিজের মধ্যে খুঁজে পায় না
চিরকালের মতো লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছে, এটা সে জাঁক করে সকলকে বললেও, সত্যি ভাবার কোনো কারণ নেইঅবিশ্যি সেটা ভাবার মধ্যে বেশ রোমান্টিকতা আছে, আত্মনিপীড়নের সুখ আছেকমলকুমার মজুমদার কি এই কারণেই নিজের হাঁপানি রোগ সারাতে চাইতেন না, বরং রাতে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন!
বুদ্ধিও যেন আজকাল তার সঙ্গে আলোছায়ার খেলা খেলছে এমনিতে খুব দ্রুত ভাবার অভ্যাস তার অনেক সময় নিয়ে ভেবে কোনো কাজ সে করে না, করলে কাজটাই হয় না কিন্তু ভাবনার সেই দ্রুততা আজকাল অনিমিখকে ঠকাচ্ছে। তার কি বয়স বাড়ছে?

এই মধ্য তিরিশেই অনিমিখ চক্রবর্তী বুড়িয়ে গেল!

খুবই বিমর্ষভাবে সে দিনদুটো কাটাল যে কেউ তাকে দেখলে ধারণা করতে পারে নিজের শরীরে খুব বিচ্ছিরি কোনো রোগের খবর অনিমিখ পেয়েছে, বা জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছে! বাড়িতে সে কথা এমনিতেই কম বলে, এই কয়েকটা দিন তা-ও বলল না স্কুলের স্টাফরুমে যতক্ষণ থাকতে হয়, একটা নতুন কেনা বইয়ে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিল বইটার কিছুই অবিশ্যি তার মাথায় ঢুকল নাএকটা শব্দও আলাদা করে তার চোখে পড়ল না সহকর্মীরা দেখলেন সে ওরহান পামুককে নিয়ে ব্যস্ত আছে কেউ ভাবলেন দেখনদারি, কেউ ভাবলেন এই লোক কেন চাকরি করতে এসেছে, লাইব্রেরিতে জীবন কাটিয়ে দিলেই পারত, বা কোনো নদীর ধারে কুঁড়েঘর বানিয়ে!

তৃতীয় দিন পঞ্চম পিরিয়ডে প্রথম মেসেজটা ঢুকল ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই আরো চারটে মেসেজ আর দুটো কলের কাঁপুনি পকেটে টের পাওয়া গেল মোবাইল সাইলেন্ট মোডে থাকায় ছেলেমেয়েরা কিছু টের পেল না কিন্তু তার গলা শুকিয়ে কাঁপতে শুরু করল ছেলেমেয়েদের কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে অনিমিখ ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তেই চটপট বেরিয়ে এল
প্রতিটি অদ্ভুত মেসেজ এবং ফোন অন্বেষার সেই পুরনো নম্বর থেকে এসেছে!
তার মানে অয়ন চিঠিটা পেয়েছে!
তার মানে অয়ন তার কৌশল ধরে ফেলেছে!
একজন অসৎ ঠিকাদারের বুদ্ধিমত্তা একজন কবির চেয়ে বেশি কী করে হয়! এটা অন্যায়! খুব অন্যায়! অনিমিখ টের পেল তার একটু কান্না পাচ্ছে টের পেল সে খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে একটু বেচাল হলে জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না
মোবাইল সে স্যুইচড অফ করল না করে লাভ নেই এমনও তো হতে পারে, অন্বেষা কোনোভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে!
স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই আরো বেশ কিছু মেসেজ ঢুকলো প্রতিটি মেসেজ চরম অশ্লীল একটা খুব খারাপ চরিত্রের মেয়েও এই ভাষায় তার পুরুষকে লোভানি দিতে লজ্জা পাবে! একমাত্র একজন স্থূল মানসিকতার পুরুষ একজন মেয়ের যৌন আমন্ত্রণের ওই ভাষা ভাবতে পারে অয়নের বুদ্ধি থাকতে পারে, কল্পনাশক্তির ছিটেফোঁটাও নেই একটুও কল্পনা যদি থাকত, অনিমিখকে ধরে ফেলাটা খুবই সোজা কাজ ও অনিমিখকে সন্দেহ করেছে, ব্যবসার শত্রু হিসেবেই, যে ওর বৌকে ফাঁদে ফেলতে চাইতে পারে, বৌয়ের প্রেমিক হিসেবে নয়
লোকটা নিজের বৌকে কি একটুও চেনে না!

স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পরে পিছনের দিকে বারবার তাকাতে তাকাতেই বাড়ি ফিরল অনিমিখ


রিয়া তার অস্থিরতা লক্ষ্য করেছেচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে তোমার? ছটফট করছ কেন! শরীর ঠিক আছে তো?’
রিয়াকে পুরোপুরি মিথ্যে বলা যাবে নাতার আচরণ দেখে সন্দেহ তো হবেই! এখন তার পক্ষে শান্ত হয়ে থাকা অসম্ভব, এমনকি শান্ত থাকার অভিনয়ও এখন করতে পারবে না সেপায়চারি করবে, করতেই হবে তাকেটেনশনের মুহূর্তে এটা সে না করে পারে না
একটা সিগারেট ধরিয়ে অনিমিখ বলল, ‘কিছু না সেভাবেদ্যাখো না, এখনও বেতন চালু হচ্ছে না! কী সব জটিলতা নাকি হয়েছে! একটু চিন্তায় আছি
রিয়া ঠাট্টা করল, ‘চাকরি চলে যাবে না তো? দ্যাখো, এই বাজারে চাকরি গেলে কিন্তু না খেয়ে মরতে হবে আমাদের! কাব্যি করে তো আর মেয়েকে খাওয়াতে পারবে না!’
রিয়া চলে গেল ওর কথাগুলো তার মনে অন্যভাবে বাজল অন্বেষার সঙ্গে তার সম্পর্কটা জানাজানি হলে সত্যিই চাকরিটা থাকবে তো! অবৈধ সম্পর্কের কারণে তাকে পুলিশ যদি গ্রেফতার করেসে আর ভাবতে পারল না সারা গা হিম হয়ে এল সে বিছানায় শুয়ে পড়ল
জানলার বাইরে ঠান্ডা অন্ধকারবিছানাটা হিম হয়ে আছেজানলা বন্ধ করতে ইচ্ছে করল না তারলেপটা টেনে নিল গায়েদূরে শহরের ট্র্যাফিকের আওয়াজ ভেসে আসছেকাছাকাছি কোনো একটা বাড়িতে একটি বাচ্চা মেয়ে গান শিখছেরান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে রিয়ার রান্নার শব্দসোনু টিভি দেখছে বসার ঘরে
আপাতত অয়ন মেসেজ এবং ফোন করা বন্ধ রেখেছে
কী প্ল্যান করছে অয়ন? কিছু না কিছু তো করছেই!
অন্বেষা কী করছে? ও সব বলে দেবে না তো! সবাই বলে এসব ব্যাপারে মেয়েদের নাকি বিশ্বাস নেই! অন্বেষা অবিশ্যি খুব শক্ত মানুষ! হয়তো অনিমিখের চেয়েও অনেক শক্ত! যে মেয়ে অতখানি উড়তে পারে, সহজে মচকাবে বলে মনে হয় না, কিন্তু ভেঙে পড়তে পারে যে কোনো ডানাই চাপের একটা সীমা পেরিয়ে ভেঙে যায়
মেয়েটার প্রতি কোনো আকর্ষণ এখন আর অবশিষ্ট নেই, কিন্তু এখন তার জীবন তো অনেকটাই ওর ডানার জোরের উপরে নির্ভর করছে!

রাত সাড়ে দশটায় অন্বেষার একটা লম্বা মেসেজ এসে ঢুকল
ও সংকেত হিসেবে সেই লজটার নাম লিখেছে প্রথমেই জানিয়েছে আজ দুপুর নাগাদ অনিমিখের হুমকি চিঠি অয়নের হাতে পৌঁছেছে জানতে চেয়েছে অনিমিখ এই পাগলামিটা সে বারণ করার পরেও কেন করল! অয়ন নাকি চিঠিটি পড়ে রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে কার চিঠি বুঝতে পারছে না সঠিকভাবে, নাহলে এতক্ষণে রিভলভার নিয়ে বেরিয়ে পড়ত বৌয়ের অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে কোনো সন্দেহই আপাতত অয়নের মনে নেই, কিন্তু আগামীকাল সকালেই অনিমিখের এই অচেনা নম্বর এবং হুমকি চিঠি নিয়ে সে থানায় ডায়েরি করতে যাবে ঠিক করেছে সেটা হলে কারো কিছু জানতে বাকি থাকবে না অন্বেষা পরামর্শ দিয়েছে অনিমিখ যেন তার এই নম্বরটাকে ব্লক করার ব্যবস্থা করে আগামীকাল সকালের মধ্যেই, পারলে ফোনটাকেও নষ্ট করে ফেলে, এবং কিছুদিনের জন্য হলেও শহর ছেড়ে চলে যায় মেসেজের শেষে অবিশ্যি লিখেছে – aamaake vul bujho naa. aami tomaake vaalobaasi. jaa bollaam koro please.
ভয় এবং রাগ, এই দুটো অনুভূতি একইসঙ্গে যে হতে পারে, অনিমিখ আজ বুঝল তার সারা শরীর হিম হয়ে গেছে আতংকে তার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে এই মেসেজ পেয়ে একদিকে ইচ্ছে করছে দৌড়তে দৌড়তে এতদূর চলে যেতে, যেখানে অয়ন তার নাগাল পাবে না, অন্যদিকে আবার তার ইচ্ছে হচ্ছে অন্বেষার গলা দুহাতে সবলে চেপে ধরতে, যেন এই পরিস্থিতির জন্য ওই মেয়েটাই দায়ীনিজের সব কিছু ভুলে গিয়ে তার মনে হচ্ছিল ওই মেয়েটাই তাকে প্ররোচিত করেছিল এই অবস্থায় এসে পৌঁছতে
অয়ন বুঝতে পারছিল সে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে এখান থেকে রেহাই সে না-ও পেতে পারে মোবাইল নম্বর থেকে তার পরিচয় তো পুলিশ অনায়াসেই পেয়ে যাবে!
তারপর?
অনিমিখ টের পেল না, তার কল্পনাশক্তি আবার পুরোদমে ফিরে এসেছে, জমিয়ে খেলছে তার সঙ্গে, বেড়াল যেমন ইঁদুরের সঙ্গে খেলে তাকে অ্যারেস্ট করা হবে? কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া দিয়ে বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে? রিয়ার মুখ তখন কেমন হবে? মা কি নেমে আসবে দোতলা থেকে? সোনু খুব কাঁদবে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার দিকে? থানায় নিয়ে যাওয়ার পরে সে প্রথমে স্বীকার করতে না চাইলে, তাকে খুব মারবে? কম্বল-ধোলাই দেবে, যাতে মারের কোনো চিহ্ন না থাকে? অথচ মেরে হাড় ভেঙে দেবে? মুখ থেকে রক্ত উঠে আসবে, গ্যাঁজলা বেরোবে মুখ থেকে? অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে আবার পেটাবে?
থানাপুলিশ সম্পর্কে অনিমিখের ধারণা এটাই
অনিমিখ টের পেল এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও সে দরদর করে ঘামছে! কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে নামছে! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে
অস্ফূটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘আমাকে শেষ করে দেবে!’
নিজের উচ্চারিত শব্দগুলো তাকে আরো আতংকিত করে তুলল বেশি কিছু না ভেবে ছাতে চলে গেল বাড়ির পাশেই একটা ছোট পুকুর আছে মোবাইলটাকে সজোরে ছুঁড়ে দিল তার দিকে অন্ধকার চিরে ভেসে এল সেটার জলে পড়ার আওয়াজ
এক ঢিলে একটা পাপ বিদায় হল!
বদল্যের হয়তো বলতেন ওটা একজন ভীরু ইস্কুল মাস্টারের পাপ! ফড়িং-এর চেয়ে বেশি পাত্তা দিতেন না!

রাতে খাওয়ার টেবিলে অনিমিখ বিশেষ কিছুই খেতে পারল না রিয়া নিশ্চিন্ত মনে ধীরে ধীরে রুটি ছিঁড়ে  ডালে ডোবাচ্ছিলসব্জি নিচ্ছিলমুখে ভরছিল চোখ বন্ধ করে সেই দৃশ্য দেখে অনিমিখের চোখে কান্নার আমেজটা ফিরে আসতে চাইল হয়তো এই রাতের পরে এই মেয়েটার জীবন আর এরকম থাকবে না সুখ কাকে বলে রিয়াকে ভুলে যেতে হবে একজন নষ্ট লোকের বৌ হিসেবে ও কোনোদিন মাথা তুলতে পারবে না তার মেয়েটাও পারবে না লজ্জা না পেয়ে নিজের বাবার পরিচয় দিতে
একটা গাড়ি খাদে গড়িয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে বেপরোয়া ড্রাইভারের মন হয়তো এরকমই হয়! কিংবা, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে একজন নির্বোধ খুনি হয়তো এভাবেই দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চায়!
সবাই তো চ্যাপলিনের ভের্দু নয়!
অনিমিখ তার জীবনের শেষটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল
গলার জমা কফ ঝেড়ে অনিমিখ বলল, ‘আগামীকাল আমি একটু বাইরে যাবো কয়েকদিন ফিরবো না
রিয়া চমকে চোখ তুলল, ‘সেকি! কিছু বলোনি তো!’
আজই জানতে পারলাম বহরমপুর যেতে হবে একটা বড়ো অনুষ্ঠান আছে
তুমি তো কবিতার অনুষ্ঠানে যাওয়া অনেকদিনই ছেড়ে দিয়েছ! স্কুলে ছুটি পাবে?’
এটায় যেতেই হবে স্কুলে যা হওয়ার হবে! দিন পাঁচেক থাকবো না একটু চালিয়ে নিও জ্যোতির্ময়বাবুকে বোলো কিছু দরকার হলে
রিয়া আর কিছু বলল না কিন্তু রেগেছে সেটা বোঝা গেল শেষ রুটিটা খেল না উঠে পড়ল অন্যদিন অনিমিখের খাওয়া না হলে ওঠে না দুজনে একইসঙ্গে বেসিনে মুখ ধোয়
শোবার ঘরে এসে দেখল রিয়া শুয়ে পড়েছে, কিন্তু আলো জ্বলছে রিয়া ঘুমের ভান করছে। সোনু অবিশ্যি তার ছোট খাটে ঘুমিয়ে কাদা
অনিমিখ নিজেই তার ব্যাগ প্যাক করলপাসপোর্ট সাইজের ছবি নিলভোটার আই ডি নিল টি এম কার্ড নিল আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সারারাত ঘুম এল না আগামীকাল সে কোথায় যাবে, এখনও ভেবে উঠতে পারছে না ঠিক করল মোবাইল মিনি স্টোরে নম্বর ব্লক করার কাজটা মিটিয়ে নিয়ে এবং নতুন একটি মোবাইল এবং সিম কার্ড কিনে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে প্রথম যে দূরপাল্লার বাসটি পাবে, সেটা যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই কোনো লজে বা হোটেলে সে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেবে এর মধ্যে যদি কোনো বিপদ না হয়, তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে আর যদি সত্যিই বাড়িতে পুলিশের ঝামেলা হয়, আপাতত বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দেবে সেটা কতদিন, পরিস্থিতি অনুসারে ঠিক করতে হবে
সে কি খুব বেশি ভেবে ফেলছে, যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি ব্যবস্থা নিচ্ছে? এই চিন্তাও তার মাথায় এল
হতেই পারে কিন্তু মধ্যবিত্ত মাস্টারের জীবন তাকে এক চিলতে ভয়েরও বিরাট প্রয়োজনীয়তা খুব কঠিনভাবে বুঝতে শিখিয়েছে শখের কবিতা লেখক এবং নারীপিপাসু অনিমিখ নয়, আগামীকাল যে শহর ছেড়ে পালাবে, সে স্কুলমাস্টার শ্রীযুক্ত অনিমিখ চক্রবর্তী (এম এস সি, বি এড) সে স্বভাবের বিরুদ্ধেও চাকরি করে নিজের পরিবারকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে আজীবন দায়বদ্ধমা, বৌ এবং মেয়ের সামনে অবৈধ সম্পর্কের দায়ে গ্রেফতার হতে চায় না নিজের শহরে পরস্ত্রীর বরের হাতে গুলি খেয়ে খবর হতে চায় না
নিজের চোয়াল শক্ত হতে দেখে এই দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল অনিমিখের

পরের দিন সকালে নটা নাগাদ সে বেরোলরিয়া কোনো কথা বলল নামা- খুশি নয় সে এইভাবে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ায়সোনু তো ঠোঁট ফোলাতে শুরু করলতার ধারণা হয়েছে বাবা কোনো মজার জায়গায় বেড়াতে চলেছে, তাদের কাউকে সঙ্গে না নিয়ে
সোনুর কান্না থামল না
বুকের মধ্যে এলোমেলো হাওয়ার শব্দ নিয়ে অনিমিখ হাঁটতে শুরু করল মোবাইল মিনি স্টোরের দিকে
মিনি স্টোরে সে জানাল তার নম্বরটি সে আর রাখতে চায় না, ব্লক করে দিতে চায়কারণ হিসেবে জানাল এখন অনেক উল্টোপাল্টা লোক তার নম্বর জেনে গিয়ে ফোন এবং মেসেজের মাধ্যমে বিরক্ত করছেওরা নম্বরটি ব্লক করে দিলসে তার ছবি এবং ভোটার আই ডি কার্ডের জেরক্সড কপি জমা দিয়ে নতুন একটি নম্বর নিয়ে নিল
এই নম্বর পৃথিবীতে এখন একমাত্র সে- জানেআর জানে মোবাইল কোম্পানি
অনিমিখের মনে হল তার অজ্ঞাতবাস শুরু হয়েছে
সে একটা নতুন ফোন কিনল
বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখল বেশ কিছু বাস তার জন্য অপেক্ষা করছেসে কলকাতা চলে যেতে পারে, দীঘা যেতে পারে, দুর্গাপুর যেতে পারে, এমনকি শিলিগুড়ি যাওয়ার একটি বাসও ধোয়ামোছা হয়ে শীতের রোদে দাঁড়িয়ে আছে
কোথায় যাওয়া যায়!
যে কোনো দিকেই কি চলে যেতে পারে অনিমিখ! যেতে হয়তো পারেকিন্তু
বাঁকুড়ার একটা বাস হর্ন দিচ্ছিলসে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল সেটা বাঁকুড়া যাওয়ার আগে বিষ্ণুপুর ছুঁয়ে যাবে কিনাকন্ডাক্টর বললেন, ‘যাবে দাদালেখাই তো আছেআমরা দু-ঘন্টার মধ্যে বিষ্ণুপুর পৌঁছে দেব আপনাকেঅন্য বাস কম করেও আড়াই ঘন্টা নেবে
মাত্র দু-ঘন্টার বাস জার্নিএবং অজ্ঞাতবাসএকটা অজ্ঞাত বাসে চেপে
অনিমিখ কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘তাই? মাত্র দু-ঘন্টায়? তাহলে বিষ্ণুপুরই যাওয়া যাক, কী বলেন?’
কন্ডাক্টরের থতমত চোখের সামনে সে বাসে উঠে পড়লবাস রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়েও পড়লতার এত ঘুম পেয়েছে নিজেই টের পায়নি এতক্ষণ

বিষ্ণুপুর পৌছল দুপুর একটা নাগাদএর মধ্যে কন্ডাক্টর তাকে বিরক্ত করেননি
ভাড়া মিটিয়ে সে নামল বাস থেকে
তাহলে এই হল মল্লরাজাদের রাজধানী! বাসস্ট্যান্ডটি তো তার নিজের শহরের চেয়ে আলাদা কিছুই নয়। হয়তো শহরের মধ্যে গিয়ে ঐতিহাসিক ব্যাপারগুলো টের পাওয়া যাবে।
অনিমিখ এগিয়ে গেল একটি ফোন বুথের দিকেএক টাকার কয়েন গলিয়ে অন্বেষার নতুন নম্বর লাগালদু-একটা রিং হতেই উল্টোদিক থেকে ভেসে এল অন্বেষার কৌতুহলী গলাসেই সঙ্গে বাচ্চাদের চেঁচামেচি অন্বেষার ক্লাসে খুব গোলমাল হয়, ও আটকানোর চেষ্টাই করে না।
তুমি স্কুলে? তবে যে চাকরি ছাড়ছ!’
তুমি কোথায়?’
অনিমিখ তেতো হাসলহাসির আওয়াজটা ভরে দিল ফোনের মধ্যে, ‘অজ্ঞাতবাসেরাধার আদেশে
ইয়ার্কি মেরো নাকী করছ তুমি এখন?’
নম্বর ব্লক করেছিফোন ফেলে দিয়ে নতুন ফোন কিনেছিএখন বিষ্ণুপুরে নামলামজানি না ফিরে গিয়ে চাকরিটা আর ফিরে পাবো কিনা! আয়ানের খবর কী? পুলিশ আসছে আমার বাড়িতে?’
পুলিশ এখনও ডায়েরি নেয়নিবলেছে ওরা কিছু করতে পারবে নাআমি আজ জোর করেই স্কুলে এসেছি অবিশ্যি পৌঁছে দিয়েছে আমাকে
অনিমিখের বুক থেকে পাথর নেমে গেলখোশমেজাজে বলল, ‘আমি জানতাম পুলিশ এসব কেস নেবে না! এত বোকা নাকি আমি? এমন ছোবল দিয়েছি, আর আমাদের নিয়ে মাথা ঘামাবে না
সেটাই দেখছিতবে ও সম্ভবত একজন প্রভাবশালী লোককে ধরেছেহয়তো তাঁর মাধ্যমে কিছু করবেবলছে এর শেষ দেখে ছাড়বে
পাথরটা আবার বুকে ফিরে এলসে শুকনো গলায় বলল, ‘তাহলে?’
তুমি একটু গা ঢাকা দিয়েই থাকোআমি তোমাকে জানাবোতখন ফিরে এসোকোনো নতুন নম্বর নিয়েছ?’
হ্যাঁ
আমাকে এখুনি একটা মিসড কল দাওআমি প্রতি রাতে একটা মেসেজ করে দেবো তোমাকে। তুমি উত্তর দেবে না। আরকোনো অবস্থাতেই আমাকে ফোন করবে নাকে জানে, এই ফোনের কথাবার্তা শোনার কোনো ব্যবস্থা করেছে কিনা! ওকে বিশ্বাস নেই সব …’
এক টাকার সময়সীমা ফুরিয়ে ফোন কেটে গেল

আর ফোন না করে, আর না ভেবে, অন্বেষার নম্বরে মিসড কল দিয়ে অনিমিখ চলল কোনো লজ বা হোটেলের খোঁজ করতে